একটি অনুভবের বিশ্লেষণ

ইশরাত জাহান

আজকে বিক্ষিপ্ত ও বাস্তব কিছু ঘটনা শেয়ার করবো সবার সাথে। আর শেষে থাকবে কিছু প্রশ্ন এবং নিজস্ব অনুভবের বিশ্লেষণ।

ঘটনা-১

আমার কাজিন নুজহাত (ছদ্মনাম) সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করা। তার বিয়ে হয়েছে বিমান বাহিনীর সুদর্শন এক অফিসারের সাথে। বছর তিন-চার না ঘুরতেই শুনলাম, বোনের গায়ে হাত তুলেছে তার স্বামী।

বাসায় দেখা করতে গেলাম। দেখি সত্যিই গায়ে ছোপ ছোপ দাগ। চোখে পানি এসে গেল। তারপর থেকে এই ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক।

ঘটনা-২

আমার পরিচিত লেডি আর্মি অফিসার (সঙ্গত কারণে নাম বলছি না)। ভালবেসে বিয়ে তাদের। স্বামী বেসরকারি বিমান কোম্পানির পাইলট। ৪ বছরের এক মেয়েসহ থাকেন লেডি অফিসারদের কোয়ার্টারে।

সেদিন শুনি, জুনিয়র অফিসারদের সামনে চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে বের করছে তার স্বামী। লেডি অফিসারও চেষ্টা করেছে আত্মরক্ষা করতে, গায়ে হাত তোলার পাল্টা জবাব দিতে।

ঘটনা-৩

আমার খুব কাছের এক বান্ধবী; সুন্দরী, বড়লোক বাবার আদুরে মেয়ে। ২০ বছরের বিবাহিত জীবনে ১৫ বছরের এক মেয়ে আছে। গত সাত বছর ধরে স্বামীর সাথে তার স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই।

আমার বান্ধবী জানালো, সে আগ্রহ দেখালেও তার স্বামী তাকে পাশের কক্ষে ঘুমাতে বলে। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। মেয়েকে ডেকে বলে তার মাকে সঙ্গ দিতে। মৌলিক এই চাহিদা ছাড়া বাকি প্রায় সব কিছুই তাদের স্বাভাবিক।

বান্ধবী এই ব্যাপারটা নিয়ে কাউকে কিছু বলতে পারে না।

ঘটনা-৪

আরেকজন বিয়ের আগে এক এয়ারলাইন্সে কাজ করতেন। বিয়ের পর স্বামীর অনুরোধে চাকরি ছেড়ে দেন। স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে তার সুখের সংসার।

কিন্তু বিয়ের ২৬ বছর পর অনুধাবন করলেন, তার স্বামী শুধু তার নিজের স্বজনদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। স্ত্রীর মা-বাবা, ভাই-বোনদের ব্যাপারে তিনি পুরাই উদাসীন।

ঘটনা-৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫ বছর আগে অনার্স, মাস্টার্স করে বের হয়ে আসা এক মেয়ে চাকরি করে। আজ এই কোম্পানি তো কাল আরেক এনজিও। দিনদিন তার কাজের পরিধি বেড়েই চলেছে। পেশাজীবী হিসেবে খুব ভালো করছে সে।

কিন্তু সবার এক কথা, ‘এইবার বিয়ে করে নে’। উপরের ঘটনাগুলির সাথে জড়িত একজন শুধু বলল, ‘না, এখনি বিয়ে নয়, মেয়েদের পায়ের নিচের মাটি আগে শক্ত হওয়া দরকার। তারপর বিয়ে’।

অনেকেই এটা শুনে বলে, ‘বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, ওর মতো এত বেশি কোয়ালিফাইড স্বামী পরে সে কোথায় পাবে?!’

এখন আপনাদের কাছে আমার প্রশ্নের পালা। আসলে মেয়েদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত হওয়া বলতে কী বোঝায়?

পায়ের নিচের মাটি শক্ত হওয়া যদি অর্থ উপার্জন করা বোঝায়, তাহলে ঘটনা-২ এর নারী তো যথেষ্টই উপার্জন করেন। তাহলে কেন তাকে রোজ রোজ স্বামীর মার খেতে হচ্ছে?

পায়ের নিচের মাটি শক্ত হওয়া বলতে যদি শিক্ষিত হওয়া বোঝায়, তাহলে ঘটনা-৪ এর নারী তো যথেষ্টই শিক্ষিত। পায়ের নিচের মাটি শক্ত হওয়া বলতে যদি বাবার টাকা থাকা বোঝায়, তাহলে ঘটনা-৩ এর নারীর বাবার তো টাকার অভাব নেই। তার নিজের রূপ, শিক্ষা সবই ছিল। তাহলে তার সাথেই বা এমন কেন হল?!

পায়ের নিচের মাটি শক্ত হওয়া বলতে যদি চাকরি করে অর্থ উপার্জন করা বোঝায়, তাহলে ঘটনা-৫ এর নারী তো স্বামী ছাড়াই অর্থে বিত্তে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাহলে তাকে কেন সব সময় বিয়ে করার কথা বলা হয়? পায়ের নিচে মাটি পাবার জন্য? আসলে পায়ের নিচের মাটি মানে কী হতে পারে?

অনেক দরিদ্র পরিবারে দেখেছি, সেখানে স্ত্রীর অবস্থান কতটা উপরে। ঘরের কোন কাজ বা সিদ্ধান্ত স্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া তিনি করেন না বা নেন না। অথচ তার স্ত্রীর না আছে টাকা পয়সাওয়ালা বাবা, না আছে তার শিক্ষাদীক্ষা, না আছে সার্টিফিকেট।

আমার মনে হয়, নারীর পায়ের তলার মাটি হচ্ছে সেই উপযুক্ত স্বামী, যিনি তার স্ত্রীকে সংসারে একজন সহযোগী হিসেবে সম্মান দিতে জানেন। তার সন্তানের মা হিসেবে অথবা একজন মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করতে জানেন। যে মান-মর্যাদা আর পরিবারে তার অবস্থানের ওপর ভর করে পুরো সংসারটাকে একা হাতে সারাদিন গুছিয়ে রাখতে স্ত্রীর ক্লান্তি লাগে না।

আমি জানি, উপরের ঘটনা বা কথাগুলির সাথে অনেকের জীবন মিলে যাবে। তাই বলছি, নতুন সম্পর্ক গড়ার আগে যাচাই করে নিন, নারীর প্রতি তার মর্যাদা বোধ কতটুকু। সেই পরিবারে তার মায়ের অবস্থান কোথায়? আমার মনে হয়, এটাই সহজ সমাধান দুর্ঘটনা এড়ানোর।

লেখক: হোমমেকার, এমএসএস (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়