কৃষিবিদ দীপক কুমার বনিক দীপু
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, বাঙ্গালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। লাখো বাঙ্গালির ঢল সেদিন নেমেছিল রেসকোর্স ময়দান অভিমুখে। প্রিয় নেতার মুখবন্ধ শুনতে, দিক নির্দেশনা শুনতে ও স্বাধীন হওয়ার স্বপ্নে সারা বাঙ্গালি তখন উন্মত্ত, অধীর।
বঙ্গবন্ধু জাতিকে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে, স্বাধীনতার চেতনায় বিভোর করেছিলেন, শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে তুলেছিলেন। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হওয়া, সমগ্র জাতিকে এক তানে আনা, হঠাৎ কোন ঘোষণায় আসেনি। দীর্ঘ ত্যাগ, তিতিক্ষা, পরিশ্রম, গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।
যে ভাষণে উদ্ভুদ্ধ হয়ে, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও, লাখো মানুষ বহ্নিমুখ পতঙ্গের মত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে হাসিমুখে, সে ভাষণকে বিভিন্ন জ্ঞানীগুণী মানুষ বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ, ৭ মার্চের ভাষণকে আখ্যায়িত করেছেন কবিতা হিসাবে, যে কবিতার কবি বঙ্গবন্ধু।

সাহিত্যের প্রাচীন শাখা কবিতা। পৃথিবীর মানুষের যখন অক্ষরজ্ঞান ছিল না, তখনও মানুষের মুখে কবিতা ছিল। কবিতা নানা সময়ে নানা রূপে এসেছে। পৃথিবীর বিখ্যাত কবিরা কবিতার সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়’।
‘কবিতা পরিতৃপ্তির বিষয়। কবিতা তখনই সার্থক হয়, যখন কবিমনের পরিতৃপ্তিতে পূর্ণতা আসে’, বলেছেন কবি শেলি। কবি মেকলের ভাষায়, ‘কবিতা বললে আমরা বুঝি সেই শিল্প, যা শব্দকে ব্যবহার করে এমনভাবে, যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন’। ‘কবিতা হলো পারফরমেন্স ইন ওয়ার্ডস’, বলেছেন কবি রবার্ট ফ্রস্ট।
কবি কোলরিজের ভাষায়, ‘গদ্য মানে শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো। আর পদ্য মানে সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।’ কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘কবিতা বোঝার বিষয় নয়, এটাকে অনুভব করতে হয়। কারণ কবি সম্ভবত বুঝেসুঝে কবিতা লেখেন না, কেবল বিষয়কে সামনে রেখে তাকে অনুভব করেই কবিতার জন্ম হয়।’
আর কবি সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, ‘কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ। সর্বোত্তম ভাবের সঙ্গে সর্বোত্তম শব্দের সংযোগই পারে সর্বোত্তম কবিতা সৃষ্টি করতে’। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছেন, ‘যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম ও একই সঙ্গে সমকালকে অতিক্রমের যোগ্যতা রাখে, তাই কবিতা।’

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনলে মনে হয়, কবিতার সকল সংজ্ঞাগুলো যেন সেই ভাষণেরই প্রতিচ্ছবি। কবির কবিতা আবৃত্তিকারের কন্ঠে হয়ে উঠে প্রাণবন্ত ও শ্রুতিমধুর। কবি ও আবৃত্তিকার দুটি ভিন্ন সত্তা।
সাহিত্য পদবাচ্যের (কবিতা এবং গদ্য) সামগ্রিক রূপকে কণ্ঠস্বরে যথাযথ প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রমিত উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রেখে বিষয়ে ধারণকৃত অনুভূতি, আবেগ, ভাব, গতি, বিরাম, ছন্দ ইত্যাদির সমন্বিত ব্যঞ্জনার প্রকাশই আবৃত্তি।
প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে আবৃত্তি শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ ছিল। শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ-বারংবার পাঠ। প্র, পরা, অপ, সম ইত্যাদি যে বিশটি উপসর্গ বাংলায় পাওয়া যায় ‘আ’ তার একটি। ‘আ’ মানে সম্যকভাবে বা সর্বতোভাবে।
সেক্ষেত্রে আবৃত্তির প্রাচীন অর্থটা হয় এ রকম- সম্যকভাবে বা সর্বতোভাবে যা পঠিত বা উচ্চারিত। খুব ক্ষীণ ক্ষেত্রেই সেরা কবি সেরা আবৃত্তিকার হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে, প্রতিটি ছন্দে, গলার উঠানামায়, কন্ঠের যে কারুকার্য করেছেন, এর চেয়ে আর কত সুন্দরভাবে করা যেত, কেউ বলতে পারবেন?
আবৃত্তির জন্য যে কন্ঠস্বর দরকার, বঙ্গবন্ধুর চেয়ে আর কার আছে এমন দরাজ কন্ঠ? আবৃত্তির যে সম্মোহনী শক্তি, বঙ্গবন্ধুর চেয়ে আর কে দেখাতে পেরেছে? পৃথিবীর আর কোন আবৃত্তিকার এর আবৃত্তি, এতো বছর ধরে, এতো বার, এতো মানুষ, এতো সময় ধরে শুনেছে?
আজকের দিনে পৃথিবী শ্রেষ্ঠ কালজয়ী কবি ও আবৃত্তিকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।