পরবর্তী ৬ সপ্তাহ কি আমাদের জন্য বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ?

ডা. মো. রোকন উজ জামান

বাংলাদেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে পরবর্তী ছয় সপ্তাহকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। এই ছয় সপ্তাহে সমন্বিত ও সময়োপযোগী ব্যবস্থা বদলে দিতে পারে বর্তমান দৃশ্যপট।

আমাদের করণীয়

  • যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. অ্যান্থনি ফাউসির মত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন নেতৃত্বের অধীনে যোগ্য, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ও ডাইনামিক একটি ন্যাশনাল টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করতে হবে, যেখানে থাকবেন দেশসেরা এপিডেমিওলজিস্ট, ক্লিনিশিয়ানস, ভাইরোলজিস্ট, মলিকুলার বায়োলজিস্ট এবং ফার্মাসিস্ট। মহামারীকালীন সকল কার্যক্রম তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে।
  • সব জেলাকে সংক্রমণের মাত্রার উপর ভিত্তি করে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করতে হবে। রেড, ইয়েলো এবং গ্রিন।
  • আন্তঃজেলার সব যাতায়াত বন্ধ করতে হবে, আওতামুক্ত থাকবে জরুরি ও খাদ্য পরিবহন। তবে রেড জোনভুক্ত জেলাগুলোকে অতিরিক্ত নজরদারিতে রাখতে হবে।
  • রুট লেভেল পর্যন্ত সার্ভিলেন্স টিম থাকবে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ তার নেতৃত্বে থাকবে।
  • সার্ভিলেন্স টিমের অন্যতম কাজ হবে প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের যদি কারো করোনার যেকোন একটি সিম্পটম থাকে, তখন তাকে দ্রুত পরীক্ষার আওতাধীন আনতে হবে।
  • সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করার সুযোগ দিতে হবে। প্রয়োজনে পিসিআর ল্যাবের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ইউনিভার্সিটির মলিকুলার বায়োলজি ল্যাবগুলো ব্যবহার করতে হবে।অ্যাডভ্যান্স টেকনোলজি ব্যবহার করে মলিকুলার বায়োলজি ও জেনেটিক ল্যাবে আমাদের দেশে যে ধরনের কোভিড সংক্রমিত হয়েছে তার জেনোম সিকোয়েন্স সহজে করতে পারি।
  • জিন এক্সপার্ট মেশিনগুলোও ব্যবহার করতে হবে এবং গণস্বাস্থ্যের কিট ইফেকটিভ প্রমাণিত হলে, সেগুলোর ব্যবহারও বাড়াতে হবে। রুট লেভেল পর্যন্ত পরীক্ষার সুবিধা তৈরি করতে হবে।
  • যে সব রোগীর টেস্ট পজিটিভ আসবে অথবা ক্লিনিক্যালি সাসপেক্টেড, কিন্তু টেস্ট নেগেটিভ, তাদের সবাইকে আইসোলেশন এবং চিকিৎসার অধীনে আনতে হবে।।
  • প্রতিটি জেলায় একটি করে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল থাকতে হবে। কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় আলাদা প্রশিক্ষিত টিম থাকবে। ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন, যাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং অতিরিক্ত ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • মাইল্ড সিম্পটমের রোগীদের বাসায় আইসোলেশনের সুবিধা থাকলে বাসাতেই চিকিৎসা দিতে হবে, তবে সার্বক্ষণিক কোভিড টিমের তত্ত্বাবধানে থাকবেন।
  • মডারেট সিম্পটমের রোগী এবং যাদের বাড়িতে আইসোলেশনের সুবিধা নেই, তাদেরকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
  • প্রতিটি বিভাগীয় শহরে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত আইসিইউ থাকতে হবে। সেখানে প্রতিটি জেলা থেকে রেফার্ডকৃত ক্রিটিকাল রোগীদের চিকিৎসা দিতে হবে।এক্ষেত্রে সকল দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের আপটুডেট চিকিৎসার জ্ঞান রাখতে হবে এবং নিয়মিত ডিজিটাল মাধ্যমে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কোভিড চিকিৎসা প্রটোকল দেশের সব হাসপাতালে একই রকম হতে হবে। সকল বিষয় ন্যাশনাল কমিটির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। তথ্যের সঠিক প্রবাহ থাকতে হবে।
  • প্রতিটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে অন্যান্য প্রয়োজনীয় টেস্টের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেমন- পোর্টেবল এক্সরে, সিবিসি, আরবিসি, এএলটি, এস ক্রিটেনিন, ডিডাইমার, এলডিএইচ, ইসিজি।
  • ঢাকার ক্ষেত্রে আগামী ২/৩ মাসের জন্য ৪/৫টি ভালোমানের বেসরকারি হাসপাতালকে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন রাখতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি হাসপাতালের প্রেষণে রাখতে হবে।
  • কিছু আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত সরকারি হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।
  • প্রতিটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে কনফার্মড ও সাসপেক্টেড দুই ধরনের রোগীকে আলাদাভাবে রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
  • প্রতিটি ননকোভিড হাসপাতালেও ট্রায়েজ সিস্টেম থাকতে হবে। ইমার্জেন্সি চেস্ট এক্সরে ও সিবিসি পরীক্ষা করে রোগীদের ভাগ করে ফেলতে হবে, যেখানে তিনি চিকিৎসা পাবেন। এতে রোগীদের ভোগান্তি কম হবে এবং রাস্তায় বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হবে না।
  • কোভিড রোগীদের ৫% ক্রিটিকাল পর্যায়ে যেতে পারে। সুতরাং ভেন্টিলেটর এর সংখ্যা বাড়ানোর দিকে আমাদের মনোযোগ না দিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। ম্যান বিহাইন্ড দ্যা মেশিন ইজ ইমপোর্টেন্ট। ভেন্টিলেটর চালানোর মত যথেষ্ট ম্যানপাওয়ার আমাদের নেই এবং অল্প সময়ে সে ধরনের কোন প্রশিক্ষণ দেয়াও সম্ভব নয়।
  • জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মিডিয়া, শিল্পীদের এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে বোঝাতে হবে করোনা কোন স্টিগমা না। এটা একটি সংক্রামক রোগ। ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সামাজিক দূরত্বের মাধ্যমে এটি থেকে দূরে থাকা সম্ভব। এই কঠিন সময়ে দূরে দূরে থেকেও সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
  • যুদ্ধ ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা খুব সহজে পরাজয় ডেকে আনতে পারে। করোনার এই মহামারীতে তাই সমন্বিত প্রয়াস একান্ত জরুরি।
  • সর্বোপরি স্বাস্থ্যকর্মীদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে চললে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে অধিকাংশ জেলাগুলো রেড থেকে ইয়োলো এবং গ্রিন জোনে পরিণত হবে। আমি আশা করি, আগামী ৬ সপ্তাহের মধ্যে দেশের সব জেলাগুলো গ্রিন জোনে পরিণত হবে এবং উহানের মতো আমরাও করোনা মুক্তির আনন্দ উৎযাপন করতে পারবো।

লেখকঃ এমবিবিএস (ডিএমসি), এফসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (নিউরোলজি), মেডিসিন ও নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ