গ্রাফোলজি বা হস্তাক্ষর বিশ্লেষণ এবং গ্রাফোথেরাপি

গ্রাফোলজি সাইকোহেলথ নিউজ

নবীন তোশনিওয়াল, ভারত

গ্রাফোলজি (Graphology) বা হস্তাক্ষর বিশ্লেষণ (Grapho-analysis) কী?

গ্রাফোলজি (Graphology) অথবা হাতের লেখা বিশ্লেষণ (Grapho-analysis) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে একজন ব্যক্তির হাতের লেখার নমুনা দেখে তাকে শনাক্ত করা যায়, লেখার মুহূর্তে তার মানসিক অবস্থা বোঝা যায় এবং তার ব্যক্তিত্ব মূল্যায়ন করা যায়।

গ্রাফোলজি’র ইতিহাস

খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে প্রথম স্বীকৃত লিপি পাওয়া যায়। হাতের লেখা দেখে কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব নির্ণয় করা যে সম্ভব, সে কথা সর্বপ্রথম সামনে আসে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে চীনা দার্শনিক কুও জো-সু বলেছিলেন, “হাতের লেখাই বলে দিতে পারে, সেটি মহান ব্যক্তির, নাকি সাধারণ ব্যক্তির”। অ্যারিস্টটলের মতে, লেখা এবং চিন্তার মাঝে এক ধরনের বন্ধন রয়েছে। লেখা আসলে বাণীর প্রতীক, প্রতিটি বর্ণই মানসিক অভিজ্ঞতার নির্দেশক।

তবে আধুনিক গ্রাফোলজির সূচনা সপ্তদশ শতাব্দীতে, ইতালির বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ক্যামিলিও বালদি’র (Camillo Baldi) হাত ধরে।‍ “কীভাবে বর্ণ দেখে লেখকের প্রকৃতি এবং গুণমান বিচার করা যায়?” শিরোনামে ১৬২২ সালে একটি বই লেখেন ক্যামিলিও বালদি। এই বইটিই হাতের লেখা বিশ্লেষণ সংক্রান্ত গবেষণার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ।

ইতালি থেকেই মানুষের প্রকৃতি এবং ব্যক্তিত্ব শিক্ষণে (Graphology) একটি স্বীকৃত মাধ্যম হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিতি পায়। সেই সময়ে অনেকেই গ্রাফোলজিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিয়মাবদ্ধ করার চেষ্টা চালাতে থাকেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন গডফ্রেড গুইলারমো লিবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬), জোহান ক্যাস্পার ল্যাভাটার (১৭৪১-১৮০১), জোহার উলফগ্যাং ভন গোয়েথে (১৭৪৯-১৮৩২) প্রমুখ।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রাফোলজির ভিত গড়ে তুলতে ফ্রান্স খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর ফলে ইউরোপ, ইসরায়েল, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, চীন এবং ভারতসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশে গ্রাফোলজির প্রসার ঘটে। আধুনিক গ্রাফোলজির সূত্রপাতও ফ্রান্সের হাত ধরেই। গ্রাফোলজির জনক বলা হয় ফ্রান্সের ক্যাথলিক যাজক, শিক্ষাবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ লেখক জ্যঁ হিপোলিত মিশন (Jean Hippolyte Michon (১৮০৬-১৮৮১)। তিনিই প্রথম দু’টি গ্রিক শব্দ ‘graph’ (লেখা) এবং ‘logos’ (তত্ত্ব) এর সমন্বয়ে Graphology শব্দটি প্রস্তাব করেন।

হস্তাক্ষর কোনও ব্যক্তির মানসিক আচরণ, সনাক্তকরণ, মূল্যায়ন এবং কোনও ব্যক্তিকে বোঝার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। ব্যবসায়িক সামঞ্জস্যতা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, ম্যাচমেকিং, ক্যারিয়ার গাইডেন্স, তদন্ত, অনুপ্রেরণা এবং ব্যক্তিত্ব নির্ধারণে হস্তাক্ষর বিশ্লেষণের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। হাতের লেখায় রয়ে যায় কিছু নিজস্বতা, কিছু বৈশিষ্ট্য, যা কিনা আপনার ব্যক্তিত্বকেই ফুটিয়ে তোলে এবং তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা সম্ভব।

কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক নবীন তোশনিওয়াল (Naveen Toshniwal) তার সংস্থা ‘ট্রেইট রিডার’ (TRAIT READER)-এর মাধ্যমে পেশাদার অনলাইন হস্তাক্ষর বিশ্লেষণ পরিষেবা নিয়ে এসেছেন, যা ভারতে প্রথম। তোশনিওয়াল বলেন, কোনও ব্যক্তির হাতের লেখার স্ট্রোক পরীক্ষা করে লেখকের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি জেনে ব্যক্তিত্বের প্রোফাইল তৈরির পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক।

হস্তাক্ষর বিশ্লেষণের মাধ্যমে নৈতিকতা, অতীত অভিজ্ঞতা, গোপন প্রতিভা, কীভাবে কেউ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া দেখায় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় জানা যায়। বলা হয় যে, হস্তাক্ষর বিশ্লেষণ ব্যক্তির ইতিবাচক ও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মোটামুটি সঠিক ধারণা দেয়। প্রিয়জন এবং সামাজিক সম্পর্ককে উন্নত করতে সহায়তা করে। তোশনিওয়ালের মতে, প্রতিদিন নিয়ম করে ৫-১০ মিনিট বিশেষ কয়েকটি স্ট্রোক অভ্যাস করলে ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে।

গ্রাফোথেরাপি

উদাহরণস্বরূপ যারা ইংরেজি ছোট হাতের ‘t’ এর বেশ উপরের দিকে কাটা দাগ দেন, তাদের আত্মমর্যাদা বেশি থাকে, তারা স্বাধীনচেতা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকেন। Looped ‘t’ এবং ‘l’ লেখা ব্যক্তিরা সাধারণত সংবেদনশীল হয়ে থাকেন। হস্তাক্ষর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বেশ কিছু থেরাপিও (Graphotherapy) শুরু করেছেন, যেখানে কিছু স্ট্রোক পরিবর্তন করে নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলিকে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন করা যায়।

অনলাইনে ট্রেইট রিডারের প্রসার ঘটিয়ে এর সুফল সম্পর্কে মানুষকে আরও সচেতন করে তোলাই তার পরবর্তী চ্যালেঞ্জ বলে জানান নবীন তোশনিওয়াল। মজার বিষয় হচ্ছে, গ্রাফোলজি দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষত ফ্রান্সে সমস্ত নিয়োগকারী / প্লেসমেন্ট এজেন্সিগুলি ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে হস্তাক্ষর বিশ্লেষণের দিকে ঝুঁকছেন। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে, বড় মার্কিন কর্পোরেশনগুলি হস্তাক্ষর বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে।

লেখক: গ্রাফোথেরাপি স্পেশালিস্ট ও প্রতিষ্ঠাতা, ট্রেইট রিডার, ভারত