সাইকোহেলথ নিউজ
বেতন-ভাতা নেই ১০ মাস। ঘরে দিনমজুর স্বামীও অসুস্থ। মুখ চেয়ে থাকে দু’টি সন্তান। তার ওপর ৪ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। চার-পাঁচদিন ধরে ভুগছিলেন জ্বরে। গতকাল বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ বুধবার সকালেই তার মৃত্যু হয়।
অন্তঃস্বত্ত্বা এই মায়ের নাম মেহেরজান বেগম মেরি। বয়স ২৮। তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শিশু বিকাশ কেন্দ্রের পরিচ্ছন্নকর্মী। জানা গেছে, ১০ মাস ধরে বেতন হয় না শিশু বিকাশ কেন্দ্রে।
মেহেরজান বেগম সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা। সেখান থেকেই নিয়মিত শিশু বিকাশ কেন্দ্রে যাতায়াত করতেন তিনি। বাড়ি থেকে প্রতিদিন অফিসের গাড়ি ভাড়া ৮০-৯০ টাকা চলে যায়। যাতায়াত ভাড়া, শিশুর ভরণপোষণ এবং অসুস্থ স্বামীর খরচ- সব মিলিয়ে এত চাপ সহ্য করা যে কোন সাধারণ নারীর পক্ষেই কঠিন।
নেপথ্যে শিশু বিকাশ কেন্দ্র
জানা গেছে, গত বছরের জুন মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে প্রকল্প চালু ও থোক বরাদ্দের আশ্বাস দেওয়া হলেও ১০ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না সারাদেশের ৩৫টি কেন্দ্রের শিশু স্বাস্থ্য চিকিৎসক, শিশু মনোবিজ্ঞানী ও ডেভেলপমেন্ট থেরাপিস্টসহ ১৭৫ জন কর্মী।
প্রায় ১৫ হাজার টাকা বেতনে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের পরিচ্ছন্নকর্মীর চাকরি করতেন মেহেরজান। কিন্তু বেতন বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাকে। দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেওয়ার ছয় মাসের মাথায় আবারও গর্ভবতী হন মেহেরজান। উর্ধ্বতনদের প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতেন, কবে বেতন হবে? ধার দেনা করেই সংসার চালাতেন তিনি।
এর আগে ফেনীতে বেতন না পেয়ে স্ট্রোকে মারা গেছেন শিশু বিকাশ কেন্দ্রের আরেকজন কর্মী। বেতন-ভাতা দূরে থাক, তাদের চাকরি আছে কি নেই—সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মীদের আন্দোলন
চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বকেয়া বেতন-ভাতাসহ চার দফা দাবি তুলে ধরেছিলেন শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা। আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও এসব বিষয়ে কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি।
শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মীদের দাবিগুলো হলো-
১. শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিগত মাসের প্রাপ্য বকেয়া বেতন ও ভাতা অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে।
২. শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোকে রেভিনিউ বাজেটের অন্তর্ভুক্তি বা সরকারি বিশেষ সেবাদানকারী গুরুত্বপূর্ণ জরুরি সেবা হিসাবে চালুর বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৩. শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাদের চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. বিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবার মান উন্নয়নের জন্য শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোর আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন করতে হবে।
বর্তমান সরকারের অবস্থান
গত ৫ মে (সোমবার) শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে সকল জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। প্রয়োজনে কেন্দ্রগুলোকে রেফারেল ব্যবস্থার আওতায় এনে রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনার সুপারিশও করা হয়েছে।
শিশু বিকাশ কেন্দ্রের গুরুত্ব
মূলত, স্নায়ু-বিকাশগত সমস্যা রয়েছে এমন শিশুদের নিয়ে কাজ করে শিশু বিকাশ কেন্দ্র। ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নির্দেশনায় শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লায়লা জামান খানের প্রচেষ্টায় শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়। পরের বছর আগস্ট মাসে পাঁচটি কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়।
পরে ২০১০ ও ২০১৪ সালে পাঁচ করে ১০টি কেন্দ্র বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালের মার্চে আরও ২০টি কেন্দ্র এই প্রকল্পে যুক্ত হয়। এই ৩৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪টি এবং জেলা সদর হাসপাতালে ১১টির কার্যক্রম চলমান আছে।
জানা গেছে, প্রতিটি কেন্দ্রে একজন শিশু স্বাস্থ্য চিকিৎসক (চাইল্ড হেলথ ফিজিশিয়ান), একজন শিশু মনোবিজ্ঞানী (চাইল্ড সাইকোলজিস্ট) ও একজন ডেভেলপমেন্টাল থেরাপিস্ট রয়েছেন। এছাড়া একজন করে পরিচ্ছন্নকর্মী থাকেন।
এর বাইরে প্রথম ১৫টি কেন্দ্রে একজন অফিস ম্যানেজারও আছেন। সব মিলে ৩৫টি কেন্দ্রে চাকরি করেন ১৭৫ জন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এই প্রকল্পে মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেন্টারে রয়েছেন আরও ১১ জন, এর মধ্যে তিনজন সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর। সর্বশেষ তথ্যমতে, মোট ১৮৬ জনের মধ্যে শূন্যপদ রয়েছে ৩৭টি।
গত বছরের জুনের একটি হিসেবে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের আগস্ট মাস থেকে ৩৫টি কেন্দ্রে প্রায় দুই লক্ষ ৩৭ হাজার ৯৩৪ শিশু স্নায়ু-বিকাশজনিত সমস্যার সেবা গ্রহণ করেছে। শিশু বিকাশ কেন্দ্রে চিকিৎসা পেশাজীবীদের একটি সমন্বিত দল স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুর একই সাথে একই সেটিংসে সকল বিশেষায়িত সেবা প্রদান করছে।
নিজ জেলায় মাত্র ১০ টাকায় শিশুরা এই সেবা নিতে পারে। সমাজের নিম্ন আর্থসামাজিক শ্রেণি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে এই শিশু বিকাশ কেন্দ্র। দেশে প্রতিবন্ধিতার হার কমিয়ে সুস্থ নাগরিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই কেন্দ্রগুলোর।