অধ্যাপক ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস
ধরুন আপনার শরীরে একটি বাঁশের ছোট টুকরো (যা এতই ছোট যে অনেক সময় চশমা দিয়ে দেখতে হয়) ঢুকে গেলো। তখন কী হয়?
আপনি সেই টুকরোকে সুই দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যতক্ষণ না বের করছেন, ততক্ষণ একটা অস্বস্তিকর ফিলিংয়ের ভিতর থাকেন। থাকেন কি-না বলুন? যে কোন ভ্যাকসিনই তো একটা বাহিরের জিনিস। সেটি শরীরে প্রবেশ করলে আপনার কিছুটা অস্বস্তি বোধ করবে না?
না করলে তো বুঝতে হবে যে, আপনার শরীরে কোন কিছু প্রবেশই করেনি! আমরা যে প্রতিবছর ফ্লু ভ্যাকসিন নিই, আমরা যে রুবেলা, হাম, মিজলস, টিবি, অন্যান্য সার্স ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়েছিলাম, তখন কি আমাদের শরীরে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়নি?
ভ্যাকসিন নিতে নিতে আমরা কি স্মলপক্স বা গুটি বসন্তকে পৃথিবী থেকে বিদায় দিইনি?
ফলে, কোভিড ভ্যাকসিনেও আপনার কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া হতেই পারে এবং সেই প্রতিক্রিয়ার ধরন নিয়ে টিকা বানানোর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে প্রচুর গবেষণা করে যারা টিকা বানিয়েছেন, সেই বড় বড় বিজ্ঞানী এবং অধ্যাপকরাই আগে সেই টিকা নিয়েছেন। কারো কিছুই হয়নি।
বড় বড় রাষ্ট্রপ্রধান এবং সেলিব্রিটিরাও টিকা নিয়েছেন, তাদের কিছুই হয়নি। এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে শুধুমাত্র অক্সফোর্ডের টিকা নেয়ার কারণে একজন মানুষও মারা যায়নি। তাহলে যে বলা হচ্ছে, ভ্যাকসিনের কারণে রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে, ইউরোপের কয়েকটি দেশ আপাতত তাদের অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে, এগুলো কী? এগুলো অন্য কিচ্ছা। এর পেছনে দু’টি কারণ আছে।
এক, ওরা যে অভিযোগগুলো পেয়েছে, সেগুলো একটু খতিয়ে দেখতে চাইছে।
দুই, ওদের অনেকেরই ভ্যাকসিন স্টক শেষ, একটু বিরতি নিতেই হচ্ছে। সময়মত সাপ্লাই নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। তাহলে আমরা কি বসে থাকবো? অবশ্যই না। এক্ষুনি ভ্যাকসিন নিয়ে নিবো।
যদি সমস্যা হয়? হতেই পারে, মাথা ঘুরাতে বা ব্যাথা করতে পারে, জ্বর আসতে পারে, ক্লান্তি লাগতে পারে, টিকার জায়গা ফুলে যেতে পারে, ব্যাথা করতে পারে। এগুলো করা মানেই আপনার টিকার সফলতা দেখা দিচ্ছে।
দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পর প্রতিক্রিয়া আরো বেশি হতে পারে।
আচ্ছা, এই ভ্যাকসিন দিলে কি আমি মরে যাবো? আমার রক্ত কি প্লাটিলেট তৈরি করা বন্ধ করে দিবে? অবশ্যই না।
দুনিয়ার কোন গবেষণা এখন পর্যন্ত এটি বলেনি। তাহলে রক্ত জমাট বাঁধা বা প্লাটিলেট কমে যাওয়ার কিচ্ছাটি কি? কিচ্ছাটি এর আগেও বলেছি।
জনস্বাস্থ্যে এটিকে বলে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড রেট’, অর্থাৎ ইউরাপের ১ কোটি মানুষকে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন দেয়া না হলেও ঐ ২৮ জনের রক্ত এমনিতেই জমাট বাঁধতো। স্বাভাবিক সময়েও একই পরিমাণ লোকের শরীরে প্লাটিলেট কমে!
গুটি বসন্তের মতো কোভিড পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়তো আর করা যাবে না।
এই কোভিড নির্মূল হলেও বাদুড় থেকে অন্য কোভিড ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে দুনিয়াতে।
মনে রাখবেন কোভিডের ভ্যাক্টর দুইটা, মানুষ এবং প্রাণী। ফলে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ একটা বিরাট ঝামেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনও হতে পারে, যে সমগ্র বিশ্বই পুরো কয়েক বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশে এটি এনডেমিক হয়ে যেতে পারে, মানে সারাদেশেই ছড়িয়ে যাবে এবং গোপনে মাঝে মাঝে হামলা দিয়ে মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মানুষ মনে করবে, লোকটা হার্টফেইল করে মারা গেছে। আসলে সে মারা যাবে কোভিডে।
আজকেই গবেষণা এসেছে যে, কোভিড হার্ট সেলের ইন্টারন্যাল মরফলোজি চেঞ্জ করে হঠাৎ করে হার্ট ফেইল করে দিতে পারে! আপাতত কিছুদিন বাঁচার একটাই পথ, আর সেটি হলো দ্রুত ভ্যাকসিন নিয়ে নেয়া। তাই, প্লিজ ভ্যাকসিন নিন। নিজেকে, নিজের পরিবারকে এবং দেশকে বাঁচান!
লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়