অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ
করোনাভাইরাস কী
করোনাভাইরাস কোন সিংগেল ভাইরাস স্পেসিজের নাম নয়। এটা একটি ফ্যামিলি। বিভিন্ন প্রাণীর দেহে এই ফ্যামিলির দুইশ’র বেশি ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে । এর মধ্যে মানব দেহে পাওয়া গেছে করোনা পরিবারের ছয় প্রজাতির ভাইরাস। এবার চীনের উহান থেকে যে আউটব্রেকটা হয়েছে, সেটা সপ্তম বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
সবগুলি ভাইরাসেরই আলাদা নাম আছে। এবারকার ভাইরাসটির নাম দেওয়া হয়েছে 2019 nCoV. মানুষের শ্বাসনালীতে মূলত এই ভাইরাস আক্রমণ করে এবং শ্বাসনালীকে সংক্রমিত করে নিউমোনিয়ার মত লক্ষণ প্রকাশ করে । অর্থাৎ জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হলো এই রোগের লক্ষণ। রোগী মারা যায় তীব্র শ্বাসকষ্ট থেকে রেসপিরেটরি ফেইলিউর হয়ে।
ইতোপূর্বে সার্স ও মার্স নামে দু’টি আউটব্রেকের কথা আমরা শুনেছি। এগুলো এই করোনা পরিবারের ভাইরাসেরই কাজ। এই ভাইরাস ছড়ায় রেসপিরেটরি ড্রপলেটের মাধ্যমে । মানে হাঁচি, কাশি থেকে বাতাসে ছড়ায়, সেখান থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে ঢোকে।
চিকিৎসা নেই। এখন অব্দি ভ্যাক্সিনও নেই। প্রতিরোধের উপায় হলো আক্রান্ত রোগীকে আলাদা করে রাখা। মাস্ক ব্যবহার করা, নিয়মিত হাত ধোয়া । পাবলিক কন্ট্যাক্ট যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা। এমনকি হ্যান্ডশেক না করারও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
চীনের উহান থেকে এই রোগ ছড়ালো কি করে
বলা হচ্ছে, ওখানকার একটা মাংসের বাজার থেকে এটা ছড়িয়েছে ৷ সমূদ্র তীরবর্তী ঐ বাজারটি বাদুর, সাপ, মুরগী, বানর, কুকুর, সামুদ্রিক প্রাণীসহ অনেক ধরনের প্রাণীর পাইকারি বাজার৷
তবে এটি সাধারণ ধারণা মাত্র । নতুন প্রজাতির ২০১৯ এনসিওভি ভাইরাসের জিন সিকুয়েন্স পরীক্ষা করার পর বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মানবদেহে পূর্ববর্তী করোনা ফ্যামিলির ভাইরাসের মিউটেশন হয়ে নতুন প্রজাতির ভাইরাসের উদ্ভব হয়েছে । অর্থাৎ এটি মানবদেহেই মিউটেশনের ফল- এমনটিও হতে পারে।
সুতরাং এটি নিশ্চিত নয় যে, চীনাদের খাদ্যাভ্যাসই এই রোগ ছড়ানোর জন্য দায়ি৷ চীনসহ পৃথিবীর বহু অঞ্চলের মানুষ এই ধরনের খাবার হাজার হাজার বছর ধরেই খাচ্ছে । তাই কোন জাতি, ধর্ম কিংবা দেশকে অপবাদ বা স্টিগমা আরোপ করবেন না । চীনের উহান ও এর আশেপাশে যে সমস্ত বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীরা আছে তাদের কোন সমস্যা হবে না, কারণ তাদেরকে ইতোমধ্যেই কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে।
ভাইরোলজি নিয়ে আমার নিজের পড়াশুনা ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে আমার গত তিন যুগের কাজের অভিজ্ঞতা বলে, যেহেতু করোনা ভাইরাস ভেক্টর বা মশা বা অন্য কোন প্রাণীর মাধ্যমে ছড়ায় না, সেহেতু এই ভাইরাসের বাংলাদেশে ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই । তাই অহেতুক আতঙ্ক না ছড়ানোর অনুরোধ রইলো সবার প্রতি।
এয়ারপোর্টে স্ক্যানিং করে এই ভাইরাস ঠেকানো সম্ভব নয়। দরকার সচেতনতা। করোনা ভাইরাস ইস্যুতে সবাই চীনাদের এক হাত নিচ্ছেন । এই ফাঁকে কেউ কেউ তাদের রেসিজম এবং ঘৃণাবাদ উগড়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ লিখেছেন, হালাল খাবার খান বলে তারা ভাল আছেন, উইঘুরের জন্য চীনাদের উপর অভিশাপ লাগছে ইত্যাদি । এগুলোর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।
অনেকেই হয়তো জানেন না, করোনা ফ্যামিলির পূর্ববর্তী একটি ভাইরাসের আউটব্রেকের নাম মারস (MERS). অর্থাৎ মিডিল ইস্ট রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম । মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে রোগের উৎপত্তি। ৮০০ লোক মারা গিয়েছিল এই রোগে। বলা হয়, উট থেকে এই রোগের সূত্রপাত।
সৃষ্টির আদি থেকেই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকূল পরস্পরের পাশাপাশি থেকেই দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছে৷ একে অন্যের রোগ শেয়ার করেছে । এটা নতুন কিছু না। অহেতুক রেসিজম আর ঘৃণা ছড়াবেন না। অন্যের বিপদ নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করবেন না। সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন। সবাইকে ভালবাসুন।
লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়