করোনাভাইরাস, ভয়ের বিষয়ই মনে হচ্ছে

অধ্যাপক ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে আমার আগের কিছু ধারণার পরিবর্তন করতে হচ্ছে। যেহেতু ভ্যাকসিন বা এন্টিবায়োটিক নেই, সেহেতু প্রতিরোধই এর ভ্যাকসিন। আমি টেকনিক্যাল বিষয়াদি এভয়েড করে যতটুকু সম্ভব সহজ ভাষায় কিছু কথা বলছি।

RNA Family Virus হওয়ার কারণে করোনা খুব দ্রুতই তার রূপ পরিবর্তন করছে এবং মিউটেশনের গাঠনিকতার এবং মুভমেন্টের ধরনটা ধরা যাচ্ছে না সহজে (ইতোমধ্যেই ৫/৭ বার মিউটেডেড হয়ে গেছে)। ফলে খুব দ্রুতই এর ভ্যাকসিন বের করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

সহসা ভ্যাকসিন তৈরি হলেও এর ফল আমাদের মত গরীব দেশসমূহের পেতে অনেক সময় এবং ঝামেলা পোহাতে হবে। এই ভাইরাসের আক্রমণে মৃত্যুহারও অনেকটাই বেশি মনে হচ্ছে।

এমনকি তাৎক্ষণিক সংক্রমণ এবং চটাস করে পড়ে যাওয়া এবং স্বল্পকালীন সময়ে মরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এবারের করোনাকে আমার HIV থেকেও ভয়ংকর মনে হচ্ছে। আগের করোনার স্ট্রেইন এতো ভয়ংকর ছিলো না। এক্ষুনি আরো সতর্ক না হলে এই করোনা বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা নিয়ে আসতে পারে। অতীত ইতিহাস তাই বলে। এই বিষয়গুলোই আমরা মেডিক্যাল সোসিওলজি কিংবা পাবলিক হেলথ এর কোর্সে পড়াই।

গ্লোবালাইজেশনের কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই ইতোমধ্যেই করোনা ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমার ধারণা পার্শবর্তী দেশ হওয়ায় এবং চীনের সাথে ঘনিষ্ট বানিজ্য এবং যোগাযোগ থাকায় বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ একটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এখানে করোনা না আসলে বলতে হবে সেটা একটা ভাগ্যের ব্যাপার। যেহেতু উইন্ডো পিরিয়ড দুই সপ্তাহের অধিক তাই এয়ারপোর্টে স্ক্যানিং করে করোনা ঠেকানো যাবে না।

ঘনবসতিপূর্ণ দেশ এবং প্রচুর উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান থাকায় বাংলাদেশে একবার করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিলে সেটা সামাল দেয়া একটা কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। আমাদের উদীয়মান অর্থনীতিকে শুধুমাত্র এই একটা ভাইরাস লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। কীভাবে? তার বিস্তারিত ব্যাখা এখানে দিলাম না। মনে রাখবেন যে, চিকনগুনিয়া কিংবা ডেঙ্গুর মত এটি শুধুমাত্র ঢাকাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। একবার আসতে পারলে ছড়িয়ে যাবে সারা দেশে।

উহান থেকে আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে চার্টার্ড ফ্লাইটে বিশেষ ড্রেস পড়িয়ে এনে আসকোনার হাজী ক্যাম্পে অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য খাওয়াদাওয়া, ডাক্তার এবং ফোন হাতে দিয়ে আলাদা করে রাখতে হবে এবং কোন আত্মীয়স্বজনকে এদের সাথে দেখা করতে দেয়া যাবে না। পুরো কাজটিই করতে হবে ICDDR,B, IECDR এবং DGHS এর যৌথ উদ্যোগে।

আমাদের সরকারি-বেসরকারি এই সংস্থাগুলো এই বিষয়ে ইতোমধ্যেই দক্ষতা অর্জন করেছে এবং এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এক্ষুনি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতে হবে যে কোন হাসপাতালে করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়া হবে।

করোনা আস্তে আস্তে পেন্ডেমিক পর্যায় থেকে গ্লোবাল এপেডেমিকের দিকে যাচ্ছে। WHO গতকাল বিশ্বব্যাপী সতর্কতা জারি করেছে। ফলে, আমাদেরকে নীচের বিষয়গুলো সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে:

  • সম্ভব হলে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যাত্রা বাতিল করতে হবে। চায়নাতে তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অন্য দেশেও বিমান যাত্রায় সার্বক্ষণিকভাবে মাস্ক পরিধান করতে হবে, এমনকি এয়ারপোর্টের বা বিমানের বাথরুমেও। এক্ষুনি চীনের সাথে সব ফ্লাইট পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিতে হবে সরকারকে। ইতোমধ্যেই কিন্তু গত দশ দিনে প্রায় ৬০০০ লোক চীন থেকে ফিরে এসেছে। সৃষ্টিকর্তা জানেন এরা কী অবস্থায় আছে দেশের ভিতর!
  • দেশে এবং দেশের বাহিরে গনজমায়েতের জায়গা, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, লিফ্ট, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি যতটুকু সম্ভব এভয়েড করা, বাহির থেকে এসে হাতমুখ ভালো করে ধুয়ে ফেলা, খামাকা নাকমুখ চোখ না কচ্লানো, প্রচুর পানি এবং কমলার রস খাওয়া, রান্নার উপকরণ ভালো করে ধুয়ে ফেলুন, অপ্রয়োজনে দরজা জানালা খুলে না রাখা, নিজের এবং পরিবারের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ইত্যাদি। মনে রাখবেন ‘সচেতনতাই করোনার একমাত্র ভ্যাকসিন।”
  • জ্বর, সর্দিকাশি এগুলো আমাদের কমন অসুখ। এগুলো হলেই করোনা ভাইরাসের কথা মাথায় না এনে ডাক্তার দেখান।
  • বেশিরভাগ প্রাণঘাতী ভাইরাসের উৎস প্রাণী, বিশেষত কলাবাদুড় এবং বার্ডস। তাই কোন অবস্থাতেই খেজুরের রস না ফুটিয়ে কিংবা কোন ধরণের দেশী বিদেশী ফল ভালো করে না ধুয়ে বা ভিনেগারের পানিতে না ভিজিয়ে পরিস্কার না করে খাওয়া যাবে না। যেকোন প্রাণীর আধা-খাওয়া ফল সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দিতে হবে।
  • স্বামী স্ত্রী বা পরিবারের কারো জ্বর কিংবা অন্য ফ্লু হলে আলাদা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সহানুভূতি কিংবা মিল-মোহব্বতের কথা আপাতত ভুলে যেতে হবে।
  • আমাদের দেশের বাতাসে এমনিতেই বিভিন্ন পার্টিকল বেশি, তাই যতটুকু সম্ভব খোলা হাওয়া একটু সাবধানে খাবেন। পার্কে ঠিক আছে।
  • সবচেয়ে বড় কথা খালি ভাত না খেয়ে একটা ব্যালেন্স ডায়েটের খাবার গ্রহণ করুন যাতে আপনার ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা ঠিক থাকে বা বৃদ্ধি পায়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা সবচেয়ে বেশী জরুরী।

সবচেয়ে বড় কথা আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে যেকোন বিপদ মোকাবিলা করা যা এখন করছে চীনের উহান প্রদেশের লোকরা। কানে কানে একটা কথা বলে রাখি, কয়েক সপ্তাহ আগে কিন্তু আমি নিজেই চীনের উহানের কাছের প্রদেশ ঘুরে এসেছি!!! বাকিটা আল্লাহ ভরসা।

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়