নারীর মনোঃযৌন সমস্যা এবং কিছু ভুল ধারণা

মোঃ আকবর হোসেন

ক্ষুধা, তৃষ্ণাসহ অন্যন্য জৈবিক বা শরীরবৃত্তীয় চাহিদার মতই যৌন চাহিদা স্বাভাবিক একটা চাহিদা আমাদের জীবনে। প্রতিটি প্রাণীর মধ্যে এই চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। মানব জাতীর অস্তিত্ব টিকে আছে একমাত্র যৌন চাহিদার জন্যই।

আপনি আমি সবাই এই যৌন চাহিদার সামাজিক বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে পৃথিবীর আলো বাতাস উপভোগ করতে পারছি। আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যও এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এটা আমাদের সবার জানা কথা।

কিন্তু আমাদের ধর্ম, সামাজিকতা, কৃষ্টি কালচারের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যৌনতা খুবই নেতিবাচক একটা বিষয়। যেটা নিয়ে আমরা খোলামেলা আলোচনা করতে পারি না। অতি গোপনীয় একটা ব্যাপার।

স্বাভাবিক যৌনতা ও সমস্যার সূত্র

যৌনতা বিষয়টা আমাদের দেশে পাপ, লজ্জাকর, খারাপ, নোংরা, নিষিদ্ধ এবং গোপনীয় হিসেবে দেখা হয়। আর এ গোপনীয়তার সুযোগ নিয়ে যৌনতা নিয়ে একশ্রেণির মানুষ ম্যালট্রিটেড (maltreated) হচ্ছে।

অধ্যবদি আমাদের দেশে যৌনতার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কোন প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ নেই। কোন দিন হবে কিনা সন্দেহ আছে। যৌনতা নিয়ে বন্ধু বান্ধব, কবিরাজ, ফুটপাতের ক্যানভাসার, পর্নোগ্রাফ, বই, বাসের জানালা দিয়ে ছুড়ে মারা লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে অপশিক্ষা লাভ করি।

যৌনতা নিয়ে এরকম সাপ্রেশনের (suppression) কারণেই আমি যদি বলি বাংলাদেশে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে, তাহলে হয়তো অনেকেই একমত হবেন না। তবে মনোবিজ্ঞানীদের মতে, যেটা আমরা নেতিবাচকভাবে মনে অবদমিত করে রাখবো, সেটা অন্যভাবে প্রকাশিত হবেই।

যেহেতু আমাদের দেশে যৌনতা নিয়ে স্বাভাবিক আলোচনা হয় না, তাই কারো কোন যৌন সমস্যা হলেও আমরা সেটা বুঝতেই পারি না। লুকিয়ে লুকিয়ে অপচিকিৎসা করে আরও খারাপ করে ফেলি। সাধারণত দু’টি কারণে আমাদের মধ্যে যৌন সমস্যা দেখা দেয়।

১. প্রাইমারি সেক্সুয়াল প্রব্লেমস (Primary sexual problems)

এটা শারীরিক বা মেডিকেল সমস্যার কারণে হয়ে থাকে, যার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। যেমন- এসটিডি (STD), এসটিআই (STI) ইত্যাদি।

২. সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল প্রব্লেমস (Secondary sexual problems)

নন মেডিক্যাল বা মানসিক কারণে এ সমস্যা হয়ে যায়। বাংলাদেশে বেশিরভাগ যৌন সমস্যা হল সেকেন্ডারি। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এটাকে মনোঃযৌন সমস্যা বা সাইকোসেক্সুয়াল ডিসফাংশন (Psychosexual dysfunction- PSD) বলা হয়। আর এর অন্যতম কারণ হলো যৌনতা নিয়ে কুসংস্কার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগ পরিচালিত এক গবেষণায় (Mozumder,K. and Rahman, M 2004) দেখা যায়, বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ মানুষের মধ্যে যৌনতা সম্পর্কে নানা রকম কুসংস্কারে বিশ্বাস রয়েছে।

নারীর মনোঃযৌন সমস্যা

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনে করা হয়, শুধু পুরুষদের মধ্যেই যৌন সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু ধারণাটি একদমই অমূলক। নারীদের মধ্যেও যৌন সমস্যা প্রবলভাবে দেখা যায়, যার জন্য মনোবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

এ সমস্ত সমস্যার পেছনে শারীরিক কোন কারণ থাকে না। তার মানে, শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ ফিট হওয়া সত্বেও যৌন স্বর্গসুখ থেকে অনেক নারী বঞ্চিত হতে পারে। যৌন সমস্যার কারণগুলো নিয়ে আরেকদিন লিখবো। আজকে এখানে আমার মূল আলোচনা হবে নারীদের মনোঃযৌন সমস্যা এবং এ সম্পর্কিত কিছু ভুল ধারণা।

সাধারণত নারীদের মধ্যে ৬ ধরনের মনোঃযৌন সমস্যা দেখা দেয়।

১. যৌন আকাঙ্ক্ষার অভাব (Impaired Sexual Interest)

এখানে নারীদের মধ্যে যৌন উত্তেজনা আসে এবং যৌন সুখ লাভ করেন। কিন্তু তাদের যৌন কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়। নিজের মধ্যে যৌন আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণে সঙ্গীর সব ধরনের যৌন আবেদন বা আচরণ তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে। এক্ষেত্রে নারী নিজে উদ্যোগী হয়ে কখনও সঙ্গীর সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয় না।

সঙ্গীর সাথে কিছু কিছু নারী যৌনতায় আগ্রহ না পেলেও স্বমেহন (Masturbate) করে যৌন সুখানুভূতি লাভ করে। স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক কলহ, ঝগড়াঝাটি, বিষণ্নতা, সঙ্গীর প্রতি সন্দেহবাতিকতা ইত্যাদি কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

২. যৌন উত্তেজনার অভাব (Impaired Sexual Arousal)

এ সমস্যায় নারীকে পর্যাপ্ত উদ্দীপ্ত (Foreplay) করা সত্বেও যৌনকাজের জন্য তার শরীর সাড়া দেয় না। সাধারণত ফোরপ্লেতে (Foreplay) নারীর যোনিপথ ভিজে যায় বা পিচ্ছিল হয়ে আসে। কিন্তু এ সমস্যার জন্য যতই ফোরপ্লে হোক না কেন, নারীর যোনিপথ সিক্ত বা পিচ্ছিল হয় না।

এতে করে যৌনকর্ম (intercourse) এর সময় যোনিপথে নারী তীব্র ব্যাথা বা জ্বালা অনুভব করেন। যার জন্য পরবর্তীতে যৌন কাজের প্রতি তার আগ্রহ কমে যায়। বিষণ্নতা, লো সেলফ স্টিম (low self-esteem), অ্যাংজাইটি (anxiety), মানসিক চাপ (stress) এবং দাম্পত্য কলহের কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

৩. চরমপুলকগত সমস্যা (Orgasmic Dysfunction)

চরমপুলক হলো যৌনমিলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তীব্র আনন্দদায়ক অনুভূতি। এক্ষেত্রে নারীর মধ্যে যৌন উত্তেজনাসহ যৌনকাজে আগ্রহী হওয়া সত্বেও তার চরমপুলক (orgasm) হয় না। কিছু কিছু নারী কোন অবস্থাতেই চরমপুলক অনুভব করেন না। আবার কিছু কিছু নারী স্বমেহন বা হস্তমৈথুন (Masturbate) করে চরমপুলক লাভ করেন।

পুরুষ সঙ্গীর দ্রুত বীর্যপাতের (Premature ejaculation) কারণেও নারী চরমপুলক লাভ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। সেক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী উভয়েরই মনোবিজ্ঞানীর কাছে চিকিৎসার জন্য যাওয়া দরকার।

৪. যোনি পেশীর সংকোচন (Vaginismus)

এ সমস্যার কারণে যৌন সঙ্গমের (intercourse) সময় নারীর যোনির চারপাশের পেশীগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। এতে করে সঙ্গী লিঙ্গ প্রবেশ করাতে পারেন না। জোর করে প্রবেশ করালেও যৌনসঙ্গম খুবই ব্যাথার হয়। এতে করে যৌনকাজের প্রতি দু’জনেরই আগ্রহ কমে যায়।

সঙ্গীর মনে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয় যে, তার স্ত্রী তাকে পছন্দ করেন না বা অন্য কোন সমস্যা আছে। অথচ যোনির পেশী সংকুচিত হওয়ার পেছনে নারীর কোন নিয়ন্ত্রণ একেবারেই থাকে না। এটা ঘটে সম্পূর্ণ অনৈচ্ছিকভাবে।

শৈশবে বা বয়ঃসন্ধিকালে বিভিন্ন নেতিবাচক যৌন অভিজ্ঞতার কারণে যৌনতাকে নোংরা, লজ্জাকর, পাপ মনোভাব নিয়ে যেসব নারী বড় হয়েছেন, তাদের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যৌনতা নিয়ে কোন তীব্র অপরাধবোধ কাজ করলেও এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর জন্যও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

৫. ব্যাথাযুক্ত যৌন মিলন (Dyspareunia)

সুখানভুতির পরিবর্তে যৌনমিলনের সময় নারী যোনির ভেতর প্রচণ্ড ব্যাথা বা জ্বালাপোড়া অনুভব করেন। এতে করে পরবর্তীতে যৌনমিলন থেকে তিনি দূরে থাকেন এবং সঙ্গীর সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়। এখানেও ছোট বেলা থেকে যেসব নারী যৌনতা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা নিয়ে বড় হয়েছে, তাদের এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

যৌনতা পাপ, লজ্জা, নোংরা ইত্যাদি মনে করায় যৌনাঙ্গ নিয়ে উদ্বিগ্ন, ছেলেদের সাথে যৌনতা নিয়ে কথা না বলা, যৌনতা বিষয়ে আলেচনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার কারণে পরবর্তীতে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

৬. যৌন অপছন্দ (Sexual Aversion)

এ সমস্যায় নারী তার সঙ্গীকে বিভিন্ন কারণে যেমন- লিঙ্গের ধরন বা আকার, বীর্য ইত্যাদির কারণে অপছন্দ করে থাকেন। বীর্য দেখলে অনেক নারীর ঘৃণা লাগে। তাই তারা সঙ্গীর সাথে যৌনকার্য থেকে নিজেকে বিরত রাখেন।

জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ার কারণে অনেক নারী তাদের সঙ্গীকে অপছন্দ করে যৌনকাজ থেকে দূরে থাকতে পারেন।

চিকিৎসার ধরন

উপরের সমস্যাগুলোর জন্য চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা সেক্স থেরাপি (Sex therapy) দিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে তাদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ থাকে। কাজেই কারো মধ্যে যদি সমস্যাগুলো দেখা যায় বা যৌনজীবন অসুখের হয়, তাহলে কোন রকম ভুল চিকিৎসা না নিয়ে সরাসরি চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

নারীদের কিছু যৌন কুসংস্কার

ভুল ধারণা-১
নারীদের চরমপুলকের সময় পুরুষের মত বীর্য বের হয়।

সঠিক ধারণা
আমাদের দেশে অনেক নারীর মধ্যে এই ভুল ধারণা আছে। নারীরাও চরমপুলক লাভ করে, তবে পুরুষের মত বীর্য বের হয় না। চরমপুলকের সময় নারীদের যোনির Pubococcygeus মাংসপেশীর ৫ থেকে ১৫ বার ছন্দময় সংকোচন হয়। এ সময় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি যোনিরস বের হতে পারে, তবে তা বীর্য নয়।

ভুল ধারণা-২
পুরুষের লিঙ্গের ওপর নারীর চরমপুলক (orgasm) নির্ভর করে। লিঙ্গ মোটা বা বড়, কমপক্ষে ৮ ইঞ্চি না হলে যৌনতৃপ্তি হয় না।

সঠিক ধারণা
যৌনতৃপ্তির সাথে ছোট বড় লিঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই। মেয়েদের যোনিপথ ১০ সে.মি. বা ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা। যোনিপথের প্রথম এক তৃতীয়াংশ সবচেয়ে বেশি উত্তেজনাকর স্থান। বাকি অংশে কম উত্তেজনা থাকে।

যৌনতৃপ্তি নির্ভর করে প্রথম অংশে কতটা ঘর্ষণ হচ্ছে তার ওপর। যোনির ভিতরের অংশটি স্থিতিস্থাপক হওয়ায় যেকোন আকারের লিঙ্গর সাথেই যোনি খাপ খাইয়ে নেয়।

ভুল ধারণা-৩
যৌন মিলনের সময় স্বামী স্ত্রী একসাথে চরমপুলক লাভ না করলে গর্ভধারণ সম্ভব নয়।

সঠিক ধারণা
গর্ভধারণের জন্য চরমপুলক মুখ্য বিষয় না। যৌন মিলনের সময় যোনি যেকোন জায়গায় বীর্যপাতের ফলে পরিপক্ব শুক্রাণু যোনির ফ্যালোপিয়ান টিউবে (Fallopian tube) প্রবেশ করে নিষিক্ত হয়ে গর্ভধারণ ঘটায়। অনেক স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যৌন জীবন সুখের না হলেও গর্ভধারণ ঘটে যায়।

ভুল ধারণা-৪
পুরুষের বীর্য পাতলা হলে বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

সঠিক ধারণা
এটা ডাহা অবৈজ্ঞানিক একটা ধারণা। শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর পরিপক্বতা ও সুস্থতার উপরই নির্ভর করে গর্ভধারণ।

ভুল ধারণা-৫
মেয়েরা হস্তমৈথুন করলে যৌনশক্তি কমে যায়। মূলতঃ হস্তমৈথুন পুরুষদের কাজ।

সঠিক ধারণা
যৌনসঙ্গী এবং যৌনকাজ না করেই যৌন সুখ পাওয়ার স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক উপায় হলো হস্তমৈথুন (Masturbation)। হস্তমৈথুনের সাথে যৌনশক্তি কমার কোন সম্পর্ক নেই। তবে সেটা স্বাভাবিক মাত্রায় হওয়া ভাল। অতিরিক্ত সবকিছুরই খারাপ দিক আছে।

আর পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও হস্তমৈথুন করে। আমেরিকায় এক গবেষণায় দেখা গেছে ৯২ শতাংশ পুরুষ আর ৬২% নারীর মধ্যে হস্তমৈথুনের অভিজ্ঞতা আছে।

লেখক:মনোবিজ্ঞানী, নাইজেরিয়া