মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার সীমাবদ্ধতা ও করণীয়

মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

সম্পাদকীয়

মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার বড় সীমাবদ্ধতাটি হলো এ নিয়ে সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা বা স্টিগমা। অন্যদিকে দক্ষ জনশক্তির অভাবও এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার বড় অন্তরায়।

সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি ও অর্থায়ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, লাখে ২ জনেরও কম মানসিক স্বাস্থ্য কর্মী রয়েছেন নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। এর বিপরীতে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে রয়েছে লাখে ৬০ জনেরও বেশি।

আশার কথা হলো, বিশ্বজুড়ে গড় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। অন্যদিকে, পৃথিবীর স্বাস্থ্যখাতের মোট বাজেটের মাত্র ২ দশমিক ১ ভাগ ব্যয় হয় মানসিক স্বাস্থ্য সেবায়। এ কারণেই এই খাতের সন্তোষজনক অগ্রগতি তেমন নেই।

মানসিক স্বাস্থ্যে স্টিগমা বা প্রচলিত কুসংস্কার হলো সমাজের অগ্রহণযোগ্যতা বা মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতি পরিবার ও সমাজের হেয় মনোভাব। সমস্যার সমাধান বা সহযোগিতার পরিবর্তে তিনি যে বিপরীত আচরণ পাচ্ছেন, তা বৈষম্য তৈরির প্রাথমিক কারণ।

আশার কথা হলো- চিকিৎসায় আসা দেশের বেশির ভাগ বা ৭২ শতাংশের বেশি মানুষ তাদের আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শে এই সেবার শরণাপন্ন হচ্ছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

মূলত স্টিগমা ভাঙতে পরিবার, প্রতিবেশী ও আশেপাশের মানুষের সাথে আমাদের নিজেদেরই কাজ করে যেতে হবে। নিজের যে কোন মানসিক রোগ বা সমস্যায় দ্রুত পরামর্শ নেয়াই একজন ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসের পরিচয় প্রদান করে। সমস্যার সমাধানে পরামর্শ নিয়ে যত দ্রুত কাজ শুরু করা যাবে, স্বাভাবিক জীবনযাপন তত বেশি সহজ ও সরল হতে থাকবে।

বিপুল জনগোষ্ঠী মানসিক স্বাস্থ্য সেবার বাইরে থাকায় পারিবারিক ও সামাজিকভাবে স্টিগমা দূরীকরণে আমাদের আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। স্টিগমা দূর করতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারি। দেশের সকল নাগরিকের মানসিক স্বাস্থ্য ও ভালো থাকা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ইতিবাচক কৌশল যুক্ত করতে পারি।

এক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে হবে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পর্যায় থেকে।

ব্যক্তিগত উদ্যোগ

ব্যক্তি হিসেবে সারাদিন আমরা একটি গণ্ডির মাঝে থাকি না। আমাদের একেকজনের পেশা একেক ধরনের। নিজেকে ভালো রাখার পন্থাগুলো জেনে সে অনুযায়ী অনুশীলনের মাধ্যমে আমি সমৃদ্ধ জীবন-যাপন করতে পারি।

আমার প্রতিদিনের রুটিনে কিছু সুনির্দিষ্ট কাজ যোগ করতে পারি, যা আমাদের সুস্থতা দিবে। যেমন: হাঁটা, রিলাক্সেশন, শখের কাজ, বেড়াতে যাওয়া, মজার কথা বলা ও শোনা, কৃতজ্ঞ থাকা, অন্যকে সাহায্য করা, নতুন কিছু জানা, নতুন কিছু পাওয়ার চেষ্টা করা, নিজ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া, ইতিবাচক চিন্তার চর্চা ইত্যাদি।

পারিবারিক ও সামাজিক উদ্যোগ

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালা বা প্রচারণা চালানো, যা কয়েক মাস অন্তর অন্তর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। পাড়া-মহল্লায় ক্রাইসিস ম্যানেজম্যান্ট এবং ওয়েলবিয়িং ভলান্টিয়ার কার্যক্রম চালু করা।পারিবারিকভাবে প্রতি মাসে অন্তত একবার মানসিক স্বাস্থ্য ফোরামের আয়োজন করা ইত্যাদি।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ

বিভিন্ন অফিসে বাধ্যতামূলক মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ছুটি প্রদান, কর্মশালা আয়োজন, ওয়েলবিয়িং ম্যানেজার বা ভলান্টিয়ার থাকা, মানসিক স্বাস্থ্য কর্মী তৈরিতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সুপারভিশন প্রদান, বার্ন আউট ম্যানেজমেন্টে কর্মীদের উৎসাহ প্রদান, স্কুল-কলেজে নিয়মিত সচেতনতা বিষয়ক কর্মশালা চালু, মানসিক স্বাস্থ্যখাতে পর্যাপ্ত বাজেট প্রদান ইত্যাদি।

এছাড়া দেশের প্রতি আনাচে-কানাচে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা পৌঁছে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহারে আরও সচেতন হতে হবে। নিয়মিত ভার্চুয়াল ও সরাসরি কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে সুন্দর আগামী গড়তে সক্ষম হবো।