সমকামিতা কি ব্যক্তির নিজের পছন্দ?

মোঃ আকবর হোসেন

সমকামিতা কী, সমকামিতা ব্যক্তির নিজের পছন্দ কি-না এবং সমকামিতা প্রমোট করা যায় কি-না, সেসব জানার আগে আসুন আমরা মানুষের যৌন দৃষ্টিভঙ্গিগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।

যৌন দৃষ্টিভঙ্গি কি?

একটা শিশু ছেলে বা মেয়ে হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও তার মধ্যে নির্দিষ্ট বয়সের আগ পর্যন্ত ছেলে বা মেয়ের যৌন বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝা যায় না। গাঠনিক দিক থেকে ছেলে মেয়ে আলাদা করা গেলেও বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝা যায় আরও পরে।

বয়ঃসন্ধিকালে আস্তে আস্তে যৌন বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। তখন একটা ছেলে বা মেয়ে বুঝতে পারে তার আবেগীয়, রোমান্টিসিজম এবং যৌন ঝোঁক বিপরীত লিঙ্গের দিকে, না সমলিঙ্গের দিকে। এ পর্যায়ে এসে সাধারণত বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ছেলে মেয়ের আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

কিন্তু এর বিপরীতও হতে পারে। মানে ছেলের প্রতি ছেলের এবং মেয়ের প্রতি মেয়ের আকর্ষণও বৃদ্ধি পেতে পারে। অনেকের আবার ছেলে মেয়ে দু’জনের প্রতিই আকর্ষণ বাড়তে পারে। যৌন দৃষ্টিভঙ্গির এটা একটা স্থায়ী প্যাটার্ন।

সাধারণত ৩ ধরনের যৌন ঝোঁক বা দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়-

হেটেরোসেক্সুয়াল বা স্টেইট: যে সমস্ত মানুষ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তীব্র আবেগ, রোমান্টিক এবং যৌন আকর্ষণ অনুভব করে, তারা হেটেরোসেক্সুয়াল । এখানে মেয়ের প্রতি একজন ছেলে এবং ছেলের প্রতি মেয়ে যৌন উত্তেজনা অনুভব করবে। এটাকে স্টেইটও বলা হয়। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ছেলেদের মধ্যে শতকরা ৯৭.৪ জন আর মেয়েদের মধ্যে ৯৭.৭% হেটেরোসেক্সুয়াল হয়।

সমকামী বা হোমোসেক্সুয়াল: এখানে একজন ছেলে ছেলের প্রতি আর মেয়ে মেয়ের প্রতি তীব্র আবেগ, রোমান্টিক এবং যৌন আকর্ষণ অনুভব করে । ছেলেদের প্রতি ছেলেদের আকর্ষণকে গে (Gay) আর মেয়েদের প্রতি মেয়েদের আকর্ষণকে লেসবিয়ান (Lesbian) বলে। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ছেলেদের মধ্যে ১.৬ শতাংশ আর মেয়েদের মধ্যে প্রায় ০.৮ শতাংশ সমকামী হয়ে থাকে।

উভকামী বা বাইসেক্সুয়াল: যারা ছেলে এবং মেয়ে দু’দিকেই আবেগীয়, রোমান্টিক এবং যৌন উত্তেজনা অনুভব করে, তারা উভকামী বা বাইসেক্সুয়াল । উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ছেলেদের মধ্যে ০.৯% এবং মেয়েদের মধ্যে ১.৪% উভকামী।

আমরা কি নিজে আমাদের যৌন দৃষ্টিভঙ্গি বেঁছে নিতে পারি?

সোজা উত্তর, না। আমরা কেউই পারি না আমাদের যৌন ঝোঁক বেঁছে নিতে। হেটেরোসেক্সুয়াল, হোমোসেক্সুয়াল বা বাইসেক্সুয়াল হওয়াটা একজন ব্যক্তির পছন্দ করা নয় । আমরা কেউ নিজের ইচ্ছে মত পছন্দ করে নেইনি যে, কে কোন যৌন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হব।

বস্তুত, আমাদের চুলের রং বা চোখের মনির রং কেমন হবে, সেটা যেমন আমাদের ঠিক করা না, তেমনি আমাদের যৌন দৃষ্টিভঙ্গি কোনটা হবে, সেটাও আমাদের ঠিক করা না।

আসলে, কেউই এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না বা কেউ কোন ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি যে, ঠিক কী কারণে বা কোন কোন ফ্যাক্টর একজন ব্যক্তির সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিশ্চিত করে। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, এর পেছনে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল, জেনেটিক, হরমোনাল, ডেভেলপমেন্টাল ফ্যাক্টর-এর সম্মিলিত যোগসূত্র আছে।

উপসংহারে আসার মত কোন গবেষণালব্দ ফলাফল বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং বিভিন্ন সংস্থা, যেমন আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স (এএপি) এবং আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) মনে করে যে, সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনটা হতে পারে নেচার (Nature) এবং নার্চার (Nurture) এ দুটোর কারণেই ।

সমকামিতাকে এমনকি মানসিক সমস্যা বা অস্বাভাবিকতাও মনে করা হয় না। কিন্তু সমকামী হওয়ার কারণে সোশ্যাল স্টিগমা (Social stigma) সম্পর্কিত মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তাই ১৯৭৫ সাল থেকে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) এর নির্দেশে সমকামীদের মানসিক সেবা দিয়ে আসছেন মনোবিজ্ঞানীরা।

অনেকেই মনে করে থাকেন যে, একটা শিশুর বাল্যকালের অভিজ্ঞতা, প্যারেন্টিং স্টাইল (parenting style) বা সে কীভাবে বেড়ে উঠলো, সেটার উপর ভিত্তি করে সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন হয়। কিন্তু এর পক্ষে বৈজ্ঞানিক কোন প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।

চিকিৎসার মাধ্যমে (যেটাকে Conversion Therapy বলে) হোমোসেক্সুয়াল থেকে হেটেরোসেক্সুয়াল করার চেষ্টা অসফল এবং ক্ষতিকর । স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের চিকিৎসার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এটা ব্যক্তির জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে ।

নিজের যৌন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মানুষ কখন বুঝতে পারে

অল্প বয়স থেকেই একজন ছেলে বা মেয়ে সন্দেহ করতে পারে, তার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন কী হতে যাচ্ছে । কিছু কিছু ছেলে বা মেয়ে পরে বলে থাকে, তাদের চাইল্ডহুড ক্রাশ, সেম সেক্স ছিল। যেটা তাদের সাথিদের বেলায় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি হয়ে থাকে।

মধ্য স্কুল বয়স বা বয়ঃসন্ধিকালে যখন ছেলে মেয়ে প্রবেশ করে, তখন তারা মোটামুটি তাদের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনটা নিশ্চিত বুঝতে পারে । কিন্তু তারা এটা অন্যদের কাছে প্রকাশ করে না। যারা প্রথমে বুঝতে পারে না যে, তারা সমকামী হতে যাচ্ছে, তারা তখন বলে থাকে যে, তারা অন্যদের থেকে আলাদা অনুভব করে বিপরীত লিঙ্গের বা সমলিঙ্গের প্রতি।

কিন্তু তারা জানে না এরকম ভিন্ন অনুভূতির কারণটা কী । সমবয়সীরা যখন তাদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের কথা পিয়ার গ্রুপে শেয়ার করে, তখন গে বা লেসবিয়ান ছেলে-মেয়েরা নিজেদের আলাদা সত্তা বুঝতে পারে এবং এটা নিয়ে তাদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয় মারাত্মকভাবে । তবে তারা বিষয়টা লুকিয়ে রাখে, বিশ্বস্ত কাউকে না পেলে তারা এটা শেয়ার করে না। সমকামিতা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন হতে এবং বিষয়টা সম্পর্কে জানতে অনেকটা সময় লেগে যায় অনেকের ক্ষেত্রেই।

সমকামিতা কি প্রমোট করা যায়?

আমার প্রফেশনাল জীবনে আমি বেশ কয়েকজন গে এবং লেসবিয়ান ক্লায়েন্ট দেখেছি । তাদের সাথে বেশ কয়েকটা সেশন কথা বলেছি। যতটুকু বুঝলাম তাদের এ সমকামিতা নিয়ে তারা নিজেরাই কেউ খুশি না । তারা নিজেরাই মানসিকভাবে খুব খারাপ থাকেন। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সম্ভব অসম্ভব সবকিছু করার চেষ্টা করেন । কিন্তু যেহেতু যৌন ঝোঁক একটা স্থায়ী প্যাটার্ন, তাই এটা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ খুবই সীমিত।

সমকামিতা ত্যাগ করা যেমন কঠিন, তেমন কঠিন কোন সাধারণ হেটেরোসেক্সুয়ালকে হোমোসেক্সুয়ালে রূপান্তরিত করা । আপনি ছেলে অথবা মেয়ে যেটাই হোন না কেন, চোখ বন্ধ করে আপনার সমলিঙ্গের প্রতি যৌন বা রোমান্টিকভাবে আকর্ষণ অনুভব করার চেষ্টা করুন। কখনও এমন অনুভব করতে পারবেন না।

তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, সমকামিতা প্রমোট করে সমকামীর সংখ্যা নতুন করে বাড়ানো যাবে না । হ্যা, যদি মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় লিঙ্গের মত সমকামিতাকেও বৈধ ঘোষণা করে, তাহলে অনেকেই প্রকাশ্যে আসবে । নিজের সমকামী পরিচয়টা প্রকাশ করবে। এটাকে কামিং আউট বলা হয়। নতুন করে কেউ সমকামী হয়ে যাবে না।

আইন, ধর্মীয় নিষেধ, কৃষ্টি-কালচার এবং সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে অনেক সমকামী নিজের পরিচয় গোপন করে নিজের মত করে সমকামী সঙ্গী খুঁজে নেয় । কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের এ যৌন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য অনেক মানসিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যায়। তারা তাদের পরিচয় সব সময়ই গোপন রাখে । তবে যারা ওয়েস্টার্ন কালচারের সান্নিধ্যে আসে, তাদের অনেকেই বিপ্লবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এটা নিয়ে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করেন।

সবশেষে, অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, সমকামী যারা, তারা তাদের এ যৌন সত্তা নিয়ে মোটেই গর্বিত না, এটা তাদের ব্যক্তিগত জীবন, পেশাগত জীবন, বৈবাহিক জীবন এবং সামাজিক জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।

আমার ছোট্ট ফ্যাক্ট বেইসড এ লেখা পড়ে সমকামীদের প্রতি আপনার আমার মনোভাব কেমন হওয়া উচিত, সেটা একান্তই আপনার আমার সুপ্রসন্ন বিবেকবোধের উপর নির্ভর করবে।

লেখক: মনোবিজ্ঞানী, নাইজেরিয়া