হেলথ গবেষণা ডেস্ক
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দূষিত হয়ে পড়ছে বাংলাদেশের নলকূপের পানি। লবণাক্ততার পাশাপাশি বাড়ছে আর্সেনিকের পরিমাণও। এর ফলে ক্যানসারের ঝুঁকিতে পড়ছে দেশের কয়েক কোটি মানুষ। বুধবার বিজ্ঞান জার্নাল পিএলওএস ওয়ান এ প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আবহাওয়ার তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অপ্রত্যাশিত বন্যা ও তীব্র বৈরী আবহাওয়ার কারণে দেশের সুপেয় পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। এর ফলে ইতোমধ্যেই ঝুঁকিতে থাকা দেশের জনস্বাস্থ্যের সমস্যা আরও জোরালো হবে। বাংলাদেশের অনেকেই ইতোমধ্যে বিষাক্ত আর্সেনিকের কারণে ত্বক, মূত্রাশয় ও ফুসফুসে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন।
গবেষণার প্রধান গবেষক, নরউইচ ইউনিভার্সিটির ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. সেথ ফ্রিসবি সম্প্রতি গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ওপর আয়োজিত প্রেজেন্টেশনে বলেন, সুপেয় পানিতে আর্সেনিক বিষের মাত্রা বাড়াই হচ্ছে মূল সমস্যা। এটা কোনো তাত্ত্বিক অনুশীলন নয়।
তিনি বলেন, ‘একবার আমি একটা গ্রামে গিয়েছিলাম; সেখানে ৩০ বছরের বেশি বয়সের কোনো মানুষ ছিল না।’
বাংলাদেশে পানিতে আর্সেনিক দূষণের সূত্রপাত হয় ১৯৭০-এর দশকে। ওই সময় দূষিত ভূগর্ভস্থ পানির জন্য শিশুমৃত্যুর হারে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। গৃহস্থালি কাজ, ফসলের সেচ এবং মাছ চাষে গভীর নলকূপের পরিষ্কার পানি সরবরাহ করতে তখন জাতিসংঘের বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা এবং এনজিওর অর্থায়নে ব্যাপক কর্মসূচি চালানো হয়।
নতুন নলকূপের পানির সুবাদে পানিবাহিত রোগের বিস্তার ঠেকানোর মাধ্যমে শিশুমৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হয়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে জানা যায়, দেশের পাললিক শিলার স্তর থেকে তোলা পরিষ্কার পানিতে উচ্চমাত্রায় প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট আর্সেনিক থাকে।
বাংলাদেশে নলকূপের পানিতে দীর্ঘস্থায়ী আর্সেনিক বিষক্রিয়ার প্রথম ঘটনার খবর পাওয়া যায় ১৯৯৩ সালে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ‘একটি জনপদের ইতিহাসে বৃহত্তম গণবিষক্রিয়ার’ ঘটনা বলে উল্লেখ করে।
ফ্রিসবি বলেন, আর্সেনিক প্রাকৃতিকভাবেই উৎপন্ন হচ্ছে। আর হিমালয় থেকেই সেটি ধেয়ে আসছে। সুতরাং গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, ইরাবতী এবং মেকং নদীর অববাহিকা প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন আর্সেনিক সমৃদ্ধ।’
তিনি আরও বলেন, মানুষ যখন ভূপৃষ্ঠের পানি পান করত, তখন কোনো সমস্যা হতো না। কারণ, ভূপৃষ্ঠের পানি বায়ুমণ্ডলে থাকা অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে আর্সেনিক অদ্রবণীয় হয়ে পানি থেকে সরে যায়। কিন্তু গভীর নলকূপের পানির সঙ্গে পরিবেশের অক্সিজেনের সংমিশ্রণের সুযোগ ঘটে না। আর তাই, হঠাৎ করে নলকূপের পানি ব্যবহার করার গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংকট শুরু হয়েছে।
ক্রমাগত আর্সেনিক গ্রহণের ফলে শরীরের ভেতরে তা জমা হতে থাকে। হাতের তালু এবং পাওয়র পাতায় ফুসকুরির মতো ত্বকের সমস্যা দেখা দেওয়ার মাধ্যমে মানুষ এর উপস্থিতি টের পায়। একই প্রক্রিয়া শরীরের ভেতরেও ঘটতে থাকে। ফুসফুসসহ শরীরের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আর্সেনিকের বিষ জমা হয়। এর ফলে ক্যানসারের সূত্রপাত হয়।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাত্রা অনুযায়ী পানিতে আর্সেনিকের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ১০ পার্টস পার বিলিয়ন (পিপিবি)।
৪৯ শতাংশ এলাকার নলকূপের খাবার পানিতে আর্সেনিক সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি বলে জানান ফ্রিসবি। তিনি বলেন, প্রায় ৪৫ শতাংশ নলকূপের পানিতেই সীমার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি আর্সের্নিক ছিল। মাঠপর্যায়ে কাজ করার সময় একটি নলকূপের পানি পরীক্ষা করে তাতে আর্সেনিকের মাত্রা পেয়েছেন ৪৪৮ পার্টস পার বিলিয়ন (পিপিবি)।
ফ্রিসবি বলেন, আমার বর্তমান হিসাবে বাংলাদেশের প্রায় ৭৮ মিলিয়ন বা ৭.৮ কোটি মানুষ আর্সেনিকের সংস্পর্শে এসেছে। আর কমিয়ে হিসাব করলেও বাংলাদেশের প্রায় ৯ লাখ মানুষ ফুসফুস ও মূত্রাশয় ক্যানসারে মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে বন্যার হার ব্যাপক বেড়ে যাবে। এতে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।
ড. ফ্রিসবি বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ততা বাড়বে। ‘লবণ প্রভাব’ খ্যাত রাসায়নিক এ পরিবর্তনের মাধ্যমে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবে।
এসব পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে। এতে বিষাক্ত আর্সেনিকের কারণে রোগ এবং মৃত্যুর হার অনেক বেড়ে যাবে বলে ড. ফ্রিসবি এবং তার সহযোগীরা গবেষণায় উল্লেখ করেন।
জলবায়ু বিরূপ পরিবর্তন হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যাবে না, তাই মানুষজাতির স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব চলতেই থাকবে দূরবর্তী ভবিষ্যৎ পর্যন্ত। বিশেষ করে পরিবেশের উচ্চ তাপমাত্রা, দূষিত বাতাস, দাবানল ইত্যাদির কারণে মানুষের শ্বাসতন্ত্র ও হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের ঝুঁকি মারাত্মক হারে বাড়ে।