আত্মহত্যার জন্য অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ মানসিক রোগটি হচ্ছে বিষন্নতা। যদি আগে থেকে সঠিক ব্যবস্থা নেয়া যায়, তাহলে জীবনের এই মর্মান্তিক পরিণতি এড়ানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, গত কয়েক মাসে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা এবং শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বেশ কয়েকটি খবর নাড়া দিয়েছে। আত্মহত্যার পর অনেক সময় এর পেছনের কারণটিকে অতি সরলী করা হয়।
অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার পেছনে কেবল একটি কারণ বা বিষয় থাকে না, এর পেছনে থাকে অনেক ঘটনা। আজ ২৬ সেপ্টেম্বর সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার কলা মিলনায়তনে আয়োজিত আত্মহত্যা বিষয়ক এক সায়েন্টিফিক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
এসোসিয়েশন অফ থেরাপিউটিক কাউন্সেলরস, বাংলাদেশ (এটিসিবি), ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সাইকোথেরাপি উইং আয়োজিত উক্ত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট- বিএপি’র সভাপতি ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ডা. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং এবং এডুকেশন সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহীন ইসলাম,অধ্যাপক ড. মাহজাবীন হক প্রমুখ ।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএসএমএমইউর মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন সভাপতি এবং এটিসিবির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন্নাহার।স্বাগত বক্তব্য দেন বিএসএমএমইউ’র মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সাইকোথেরাপি উইং প্রধান এবং এটিসিবির সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগিন।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করছেন। আর বাড়ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা। এমনকি বিত্তবানেরাও আত্মহত্যা করছেন।
সম্প্রতি ঢাকায় ফেসবুক লাইভে এসে আবু মহসিন খান নামের এক ব্যবসায়ীর নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা দেশের মানুষকে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে। এতে উঠে এসেছে নগর জীবনের নিঃসঙ্গতার কথা।
তিনি একজন চিত্রনায়কের শ্বশুর হওয়ায় আলোচনাটা হয়তো একটু বেশি হয়েছে। অবশ্য এটাই প্রথম নয়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বলা যায় ফেসবুক লাইভে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে।
বক্তারা বলেন, যদি আলোচিত আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে হঠাৎ করে নয়, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তার মৃত্যুর পর মানুষ কীভাবে ঘরে ঢুকবে তার ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন। এটা একাকীত্ব থেকে গভীর বিষন্নতার ফল।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আত্মহত্যা প্রবণতার পিছনে মনোসামাজিক, পারিপার্শ্বিক চাপ এবং মানসিক রোগ একটা বড় ভূমিকা রাখে। অর্থনৈতিক ক্রাইসিস, বেকারত্ব, পেশাগত হতাশা, ইনসোমনিয়া, পরিবার এবং সামাজিক প্রত্যাশা বৃদ্ধি, একাকীত্ব মানুষের মধ্যে চরম হতাশা তৈরী করে।
বুলিং, নির্ঘুম রাত, প্রেমে সম্পর্কে টানাপোড়েন, বাবা-মায়ের প্রতি অভিমান, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। মানসিক রোগের কারণেও আত্মহত্যার হার বাড়ছে যা আমাদের অগোচরে রয়ে যাচ্ছে।
বিষন্নতা, মাদকাসক্ত এবং সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার আশংকা ৫ থেকে ৮ শতাংশেরও বেশী। সাথে শুচীবায়ুর লক্ষণ, উদ্বিগ্নতা, ইনসোমনিয়াও দেখা যায়। সাইকোলজিকাল অটোপসীতে দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের ৯০ শতাংশ মানসিক রোগী।
সবচেয়ে বেশী ছিলেন মাদকাসক্ত (মদ) আর তারপরেই ৬০ শতাংশ মুড ডিসঅর্ডার বিষন্নতা, বাইপোলার রোগে ভুগছিলেন। দেখা যায় যারা দিনে ৩-৭ ঘন্টা ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাদের ৮৮ শতাংশ বিষন্নতায় ভোগেন; বক্তারা আরও বলেন, আত্মহত্যার ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি।
আশেপাশে কেউ যদি হঠাৎ বেশি চুপচাপ হয়ে যায় কিংবা বিষন্নতায় থাকে। আগে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, এমন ব্যক্তির প্রতি বেশি খেয়াল রাখতে হবে। কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা থাকলে। কেউ যদি আত্মহত্যা করতে পারলে ভাল হতো এমন কথা বলে।
বক্তারা আরও বলেন, অনেকেই ভাবেন যারা আত্মহত্যা করে তারা কোন প্রমাণ রাখে না। এমনটি ভাবা যাবে না। যারা আত্মহত্যা করে তারা অনেক আগে থেকেই কিছু সংকেত দেয়, যা হয়ত কেউ গুরুত্ব দেয় না। অনেকেই ভাবেন যে, কেউ আত্মহত্যা হতে বেঁচে গেলে পরবর্তীতে আর করবে না। এটাও ভূল ধারণা।
কেউ আত্মহত্যা হতে বেঁচে গেলে পরবর্তীতে আবার সে একই পদক্ষেপ নেয়। যেসব পরিবারে কেউ আত্মহত্যা করেছে, এমন পরিবারে নিকটাত্মীয়রা শিক্ষা পেয়ে করবে না, এটাও ভুল। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব পরিবারের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বরং বেশি।
সূত্র: ডাক্তার প্রতিদিন