ডা. সাঈদ এনাম
কনভারসন ডিসঅর্ডার একটা রহস্যময় রোগ। মনের লুকানো কষ্ট, ব্যাথা-বেদনা শারীরিক আচার-আচরণে প্রকাশ পায়। এজন্যে এই রোগের নাম কনভারসন।
এর লক্ষণ কী
এই রোগে রোগী হঠাৎ করে অজ্ঞানের মতো পড়ে যান। সাধারণত সবার সামনে, ঘরে, বিছানায় পড়ে যান। এতে কোন রূপ ব্যাথা পান না, ঠোঁট, জিহ্বায় কামড় পড়ে না বা পরিধেয় কাপড় ভিজিয়ে দেন না। তিনি পুরোপুরি অজ্ঞান হন না।
তার চোখের পাতা টিপটিপ করে নড়তে পারে, জোরে জোরে এবড়ো থেবড়োভাবে হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করেন, লম্বা শ্বাস টানেন, অনেকক্ষণ দম নিয়ে আটকে রাখেন, চিৎকার বা কান্নাকাটি করেন, উল্টোপাল্টা কথা বলেন।
বিশেষ কোন কিছু ভুলে যান বা মনে করতে পারেন না, কখনো কখনো তার পুরো শরীর আধা ঘন্টা থেকে কয়েক ঘন্টা যাবৎ অনবরত ধুম-ধাম কাঁপতে থাকে, এমনও আছে হঠাৎ করে কথা বলতে পারেন না অথবা ফিস ফিস করে কোন মতে কথা বলেন।
শুরুতেই বলেছি রোগী কখনই ইচ্ছে করে এসব আচরণ করেন না। অবচেতন মনেই করেন। অনেকে মৃগী রোগ ভেবে ভুল করেন।
রোগ নিরূপণ
সাইকিয়াট্রিস্ট সাধারণত রোগীর ইতিহাস থেকেই এই রোগ নিরূপণ করেন। সিটি স্ক্যান (CT Scan) বা এমআরআই (MRI) তে কিছুই পাওয়া যায় না। তবে ফাংশনাল এমআরআই (f-MRI) তে কিছু পরিবর্তন পাওয়া যেতে পারে।
কাদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়
সব বয়সের নারী এবং পুরুষের হতে পারে। তবে অল্প বয়সী মেয়ে, তরুণী, গৃহবধুদের মধ্যে এই রোগ বেশী দেখা যায়।
প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি
বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে এই রোগ নিয়ে সচেতনতা কম। কম বলতে একেবারে কম। একে কেউ বলে ‘ভুতে ধরা’, কেউ বলে ‘পাগল’, কেউ বলে ‘ভং ধরা’, কেউ বলে ‘যাদু-টোনা’।
কনভারসন ডিসওর্ডারে যেসব চিকিৎসা দিতে দেখা যায়
- নাকে মরিচ পোড়া দেয়া, গরম পানি ঢুকিয়া দেয়া
- সুই গরম করে কপালে দেয়া
- লাঠি পেটা করা
- লিটল ফিংগার ভেংগে দেয়া
- সেক্সুয়ালি এবুউসড বাই কবিরাজ
- ধুয়ার মধ্যে ফেলে রাখা
- ঝাড়ু দিয়ে পিটানো
- বিয়ে পড়িয়ে দেয়া
- ঠাণ্ডা পানিতে চুবানো
- পয়সা গরম করে সেঁকা দেওয়া
- লোহা দিয়ে কানের লতিতে ছিদ্র
- পাগলা বাবার তাবিজ
- ল্যাংটা পীরের থুতু খাইয়ে দেয়া
- নাকে মুখে গরম তেল ঢুকিয়ে দেয়া
- টিগ্রেটল
- ফ্রেংজিট, লিংজিট
- নেভুলাইজেশন
- অক্সিজেন
- স্যালাইন
- নাকে নল দেয়া
আরো অনেক মর্মান্তিক ভণ্ড ও ভুয়া চিকিৎসা পদ্ধতি আছে৷ এগুলো সবই ভুল চিকিৎসা। অনেক সময় রোগীর মৃত্যুও হয় চিকিৎসার নামে এসব ভয়াবহ অমানবিক অত্যাচারে। আসলে এ রোগ সম্পর্কে জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবেই এমন হয়।
সঠিক চিকিৎসা
সাইকোথেরাপি এর একমাত্র চিকিৎসা। রোগীর সাথে একান্তে আলাপ করা। তার মনের কষ্ট বের করে আনা। রোগীকে বুঝানো। সমস্যা সমাধানে পাশে থাকা। এর মাধ্যমে শতকরা একশ’ ভাগ রোগীই সুস্থ হন। তাই আসুন সচেতন হই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি, সিলেট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশনের ইন্টারন্যাশনাল ফেলো, রয়েল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্ট ইংল্যান্ডের সদস্য