হঠাৎ মৃত্যুর ভয় গ্রাস করে নেয় অদ্ভুত মানসিক রোগ ‘প্যানিক এটাক’

ডা. সাঈদ এনাম

এক. আপনি বসে আছেন বা রাস্তায় হাঁটছেন, ধরুন হটাৎ একটি বিষাক্ত সাপ সামনে পড়ে গেলো। দেখলেন সে ফনা তুলে আপনার দিকেই এগুচ্ছে। এমতাবস্থায় আপনি দৌড় দিয়ে পালাতে গিয়ে দেখলেন আপনার হাত-পা অবশ। আপনি নড়তে পারছেন না, ছুটতে পারছেন না! এভাবে কয়েকমিনিট। তখন আপনার মানসিক ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া কি ভেবে দেখুনতো?

আপনার হার্টবিট বাড়তে থাকবে, আপনি ভয়ে থরথর কাঁপতে থাকবেন, আপনার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হতে থাকবে, সারা দেহে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যাবে, আপনি ঘামতে থাকবেন, চোখে ঝাপসা দেখবেন, ব্রেইন কাজ করবেনা, সব শুন্য মনে হবে, গলা মুখ শুকিয়ে যাবে, নিশ্চিত মৃত্যুর ভয়ে আপনাকে তাড়া করতে করতে গ্রাস করে ফেলবে। হয়তোবা অচেতন হয়ে ধপাস করে পড়ে যাবেন।

আসন্ন বিপদে আমাদের শরীর ও মনের এমন প্রতিক্রিয়া কে বলে “ফাইট অর ফ্লাইট” রেসপন্স।

এই ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স ন্যাচারাল। সর্বশক্তিমান আল্লাহ অথবা যে নামেই ডাকুন, তিনিই বিপদের সময় আমাদের ব্রেইন ও দেহে এই রেসপন্স স্বয়ংক্রিয় হবার সিস্টেম রেখেছেন। এই রেসপন্স এর জন্যে হয় আমরা বিপদে ‘প্রাণপণে লড়াই করি’ না হয় বিপদ থেকে ‘সরে পড়ি’।

আমেরিকান চিকিৎসা বিজ্ঞানী ওয়াল্টার ব্র‍্যাডফর্ড ক্যানন সর্বপ্রথম ১৯১৫ সালে এই ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স ব্যাখ্যা করেন তার বিখ্যাত মেডিকেল বই “বডিলি চেইঞ্জেস ইন পেইন, হাংগার, ফিয়ার, এন্ড রেজ” বইয়ে।

এই রেসপন্স আমরা প্রচুর শক্তি যোগায় এবং বিপদ মোকাবেলা করি। এ সময় আমাদের ব্রেইনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অস্বাভাবিক পরিমানে এড্রিনালীন (Adrenaline / Epinephrine) নামক একটি হরমোন (স্বাভাবিক এর তুলনায় দ্বিগুনেরও বেশী) নি:সৃত হয় এবং এর প্রভাবেই আমাদের শরীর ও মনে শক্তি আসে। বিপদকালীন সময়ে এ হরমোন নি:সৃত হয় বলে একে বিপদ কালীন হরমোন।

দুই.

এখন ধরুন আপনি বসে আছেন বা হাঁটছেন। আপনার সামনে কোন সাপ নেই, বিচ্ছু নেই, বাঘ নেই, নেই কোন বিপদ বা বিপদের আশংকা। সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ। কিন্তু হটাৎ করে আপনার দেহ-মনে শুরু হয়ে গেলো ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স। তাহলে কি হবে?

আপনি অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকবেন, আপনার পালপিটিশন বাড়তে থাকবে, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত ঘেকে দ্রুততর হতে থাকলো, ঘামতে থাকলেন, ধীরে ধীরে মৃত্যু ভয় আপনাকে গ্রাস করে নিলো।

চমৎকার শান্ত নিরব পরিবেশে কোনরূপ বিপদ আপদের আশংকা ছাড়াই যদি আপনার দেহ মনে ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স ( Fight or Flight Reaponse) স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে চালু হয়ে যায় তবে সেই অবস্থা’কে নিউরো-সাইকিয়াট্রির পরিভাষায় বলে “প্যানিক এটাক” ( Panic Attack)। আর যদি জীবন চলার পথে প্রায়ই আপনার এমন হয় তাহলে তাকে বলে প্যানিক ডিসওর্ডার (Panic Disorder)।

আসুন জেনে নেই, প্যানিক এটাক বা প্যানিক ডিসওর্ডার কি?

প্যানিক এটাক (Panic Attack):

কোন কারন ছাড়াই হটাৎ করে স্বল্প সময়ের জন্যে দেহ-মনের মধ্যে তীব্র ভয়ের উদ্রেক হওয়া এবং তার ফলে নিউরো-সাইকিয়াট্রিক কিছু উপসর্গ দেখা দেয়াকে বলে প্যানিক এটাক। আমাদের সমাজে প্রচুর মানুষ আছেন যারা প্যানিক এটাক বা প্যানিক ডিসওর্ডার এ ভুগের কিন্তু লজ্জায় বলতে পারেন না। আর বললেও কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই হেসে উড়িয়ে দেয় কিংবা জ্বীন-ভুতের আছর বলে।

প্যানিক এটাকের শারীরিক ও মানসিক যে সকল উপসর্গ দেখা দেয় তা হলো নিম্নরূপ,

বুক ধরফর করা,
ঘেমে যাওয়া,
শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত তর হতে থাকা,
শ্বাসপ্রশ্বাস আটকে যাবার মতো অবস্থা
হাত পা কাঁপতে থাকা,
বুকে চাপ অনুভূত হওয়া,
মাথা ঘোরানো, ঝিম ঝিম, মাথায় শুন্যতা সৃষ্টি,
সারা গা বেয়ে ঝিন ঝিন শিন শিন করে অনুভূতি উঠা,
নিজেকে বাস্তবতা থেকে হারিয়ে ফেলা,
এই বুঝি হার্ট এটাক হয়ে মরে গেলাম, এ রকম মনে হওয়া

প্যানিক এটাক রোগীর মধ্যে খুব বেশী সময় স্থায়ী থাকে না। সাধারণত উপসর্গ হঠাৎ শুরু হয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায় এবং তা মাত্র ১৫/২০ মিনিট স্থায়ী থাকে । এরপর ধীরে ধীরে রোগী স্বাভাবিক হয়ে যায়। রোগী আগের মতো চলাফেরা করতে পারে। মুলত: এই উপসর্গ গুলো মনের ভুলে হয়।

প্যানিক এটাক এর ফলে কি হয়?

পুরো ব্যাপারটি অল্প সময়ের জন্যে হলেও এ অবস্থা একজন রোগীর জন্যে ভয়ানক যন্ত্রণার। প্যানিক এটাক হয় যাদের হয় একমাত্র তারাই বুঝেন এর যন্ত্রণা। কারন এসকল মানসিক ও শারীরিক উপসর্গ কয়েক মিনিট থাকাই মানেই একজন সাধারণ মানুষের ভীষণ বিভীষিকাময়!

অনেকে আবার প্যানিক এটাক কে ভুল ভেবে মনে করেন তার হার্ট এটাক হচ্ছে, বা এজমা রোগ দেখা দিয়েছে। যদিও প্যানিক এটাকের সময় রোগী মনে করেন যে, তিনি এই বুঝি মারা যাচ্ছেন, কিন্তু আসলে প্যানিক ডিসওর্ডার রোগে কেউই মারা যায়না।

প্যানিক ডিসওর্ডার কি (Panic Disorder) ?

একজন মানুষের মধ্যে যখন বার বার প্যানিক এটাক দেখা দেয় কিংবা প্যানিক এটাক হবে জবে এই ভেবে সারাক্ষণ যখন একজন মানুষ প্রায়ই ভীত সন্ত্রস্ত থাকেন তখন এ অবস্থাকে বলে ‘প্যানিক ডিসওর্ডার’।

অনেকের আবার প্যানিক এটাক হয় নির্দিষ্ট কোন নির্দিষ্ট স্থানে গেলে। এমন স্থান, যেখান থেকে থেকে সহসা বের হয়ে সম্ভব না সেরকম স্থান। যেমন,

ভীড়, কোলাহল,
জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান স্থল,
ক্লাব, মার্কেট, বাজার, শপিং মল,
বদ্ধ ঘর বা আবদ্দ হল ঘর,
জনাকীর্ণ বিয়েবাড়ি বা কমিউনিটি সেন্টার,
লিফটের ভিতর, এলিভেটর এ,
প্লেন, ট্রেন, বাস বা স্টিমারের ভিতর,
উঁচু দালানের ছাদে গেলে
কিংবা কোন উঁচু ব্রীজ এ উঠলে।

এ সকল স্থানে গেলে রোগীর প্যানিক এটাক হয় বিলে তিনি এসব জায়গা এড়িয়ে চলেন। এ অবস্থা কে বলে ‘প্যানিক ডিসওর্ডার উইথ এগোরা ফোবিয়া’। (Panic Disorder with Agoraphobia)।

এগোরাফোবিয়া কি?

এগোরাফোবিয়া (Agorakhobia) হলো গ্রীক শব্দ। গ্রীক ‘এগোরা’ শব্দের অর্থ জনাকীর্ণ বা কোলাহলে পরিপূর্ণ স্থান বা মার্কেট প্লেস বা এসেম্বলি প্লেস। আর ‘ফোবিয়া’ অর্থ ভয়। অর্থাৎ জনাকীর্ণ বা কোলাহল পূর্ণ স্থানে যেতে ভয় বা গেলে ভয়।

প্যানিক ডিসওর্ডার এর জন্যে অনেক রোগী প্লেন চড়েন না। বার বার প্লেনে বা ট্রেনে চড়ে যাত্রার আগেই ভয়ে দৌড়ে বের হয়ে আসেন। আমি এমন অনেক পেশেন্ট পেয়েছি।

এ রোগের চিকিৎসা কি আছে?

হ্যা। এ রোগের কার্যকরী চিকিৎসা রয়েছে। এই মানসিক (নিউরো-সাইকিয়াট্রি ) রোগ থেকে সম্পুর্ন ভাবে নিরাময় সম্ভব।

কি চিকিৎসা?

সাইকোথেরাপি, রিলাক্সেশন থেরাপি, কার্যকরী মাত্রায় সেরোটোনিন রি-আপটেক ইনহিবিটর (SSRI) মেডিসিন অত্যন্ত কার্যকরী। ঔষধ সেবন ও সাইকিয়াট্রিস্ট কিংবা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এর সাইকোথেরাপিতে রোগী সম্পুর্ণ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে যাপন করতে পারেন।


লেখক: এমবিবিএস (ডিএমসি) এমফিল (সাইকিয়াট্রি) বিসিএস (হেলথ)
সহকারী অধ্যাপক সাইকিয়াট্রি
সিলেট মেডিকেল কলেজ।

ইন্টারন্যাশনাল ফেলো,
আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন (APA)
ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েট মেম্বার,
রয়েল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্ট ইংল্যান্ড (RCPsych)
রয়েল অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্ট (RANZCP)

(ব্রেইন স্নায়ু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ)