সূচনার গল্পে সেক্সুয়াল সেডিজম ডিসওর্ডার

ডা. সাঈদ এনাম, আত্মহত্যার চিন্তা,

ডা. সাঈদ এনাম

সূচনা (ছদ্মনাম) নামে একজন এসেছেন ডিপ্রেশন নিয়ে। বেশ ক’দিন যাবৎ সবসময় তার মন খুব খারাপ থাকে। কোন কিছুতেই আর আনন্দ বা আগ্রহ বোধ করেন না। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। বেঁচে থাকতে তার আর ইচ্ছে হয় না।

তার ডিপ্রেশনের কারণ হিসেবে যা বোঝা গেলো, তিনি স্বামী কর্তৃক চরম নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার। তার স্বামী একজন ‘সেক্সুয়াল সেডিজম ডিসওর্ডার’ এর পেশেন্ট।

সূচনার স্বামীর যে মানসিক রোগ ‘সেক্সুয়াল সেডিজম ডিসওর্ডার’, এটি তিনি আজই প্রথম জানলেন। রোগটা কী, এ সম্পর্কে তিনি সম্যক ধারণাও পেলেন।

‘সেক্সুয়াল সেডিজম ডিসওর্ডার’ রোগী ‘সেক্সুয়াল’ এক্টিভিটির পূর্বে তার বেড পার্টনারকে বেধড়ক পেটাতে থাকে, গালি গালাজ করতে থাকে, সেই সাথে চলে তাকে নিয়ে নানান অপমান সূচক মন্তব্য এবং সন্দেহমূলক, অশালীন অসভ্য কথাবার্তা। এতে রোগী সেক্সুয়াল আনন্দ পান। তার জন্যে এটা একটা পৈশাচিক আনন্দময় মূহুর্ত!

যাহোক, বিগত ১৭ বছর এসব সহ্য করার পর সূচনা এখন আর পারছেন না। এখন এতোটাই হতাশাগ্রস্ত ও বিরক্ত যে, তিনি স্বামীকে এবার তালাক দিবেনই। একাই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু কোথাও তার যাবার জায়গা নেই। মাঝেমধ্যেই সূচনা ভাবেন সুইসাইড করার কথা।

মধ্যবয়সী স্যাডিস্টিক লোকটা সূচনাকে বিয়ে করেছে অনেকটা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে। লন্ডন থেকে প্রথমে সে সূচনাকে রং নাম্বার হিসেবে ফোন দেয়। সুন্দর সুন্দর কথা বলে এবং রঙীন স্বপ্ন দেখায়।

কলেজ পড়ুয়া সূচনা ফাঁদ বুঝে না। অবশেষে পালিয়েই বিয়ে করে। যার ফলে পরিবার থেকেও বিচ্যুত হয়ে যায় সে। তাই তার ফিরে যাবার পথও বন্ধ। সূচনার বিয়ের ১৭ বছর চলছে। সন্তান আছে একটি। সেই সন্তানকে ইংল্যান্ডে নিয়ে গেছে স্যাডিস্ট বাবা।

কিন্তু স্যাডিস্ট স্বামী তার স্ত্রীকে ইংল্যান্ডে নেয়নি এবং নেবে না বলে দিয়েছে। কারণ সে প্রায়ই বলে, ‘তোকে ইংল্যান্ডে নিলে তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি, আমার বদনাম করে বেড়াবি’।

সূচনা (ছদ্মনাম) জানালেন, তার গায়ে এমন কোন জায়গা নেই যে কামড়, মার বা কাটার দাগ নেই। আর সেক্সুয়াল এক্টিভিটির পূর্বে অপমানসূচক কথাবার্তাগুলো এতোটাই নিচ প্রকৃতির যে, একজন সুস্থ সাধারণ মানুষ তা মুখেও আনতে পারবে না। এসব বলে সূচনা কেবল কাঁদতে থাকলেন।

ভদ্র মহিলার সাথে আলাপে আরো বোঝা গেলো, সেই স্যাডিস্টের আবার ‘ইরেকটাইল ডিসফাংশন’ যেমন আছে, তেমনি আছে ‘প্রিম্যাচুওর ইজাকুলেশন’। মারামারি ও গালিগালাজের সময়ই তার অর্গাজম হয়ে যায়।

অর্গাজম হলে সে তাৎক্ষণিক কিছুটা নরম মেজাজের হয়, নির্যাতন বন্ধ করে। তবে তার ভয়ংকর আচরণ নিয়ে সে কখনোই অনুতপ্ত হয় না। রাত হলেই আবার শুরু হয় একই কায়দায় পৈশাচিক নির্যাতন।

ভ্যাকেশন কাটাতে যে ক’দিন সে বাংলাদেশে থাকে, চলে তার এই পৈশাচিক নির্যাতন। এখানে একটা কথা বলে রাখি, সেক্সুয়াল সেডিজম ডিসওর্ডার রোগের সাথে অনেক সময় ওই রোগীর ‘এন্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার’ও থাকে। এতেই ঘটে যায় মারাত্মক দূুর্ঘটনা, হত্যাকাণ্ড। এ এক ভয়ানক পরিণতি।

এটা স্যাডিস্টের ছিলো ২য় বিয়ে। প্রথম স্ত্রী ছিলো বাংলাদেশ বংশদ্ভুত বৃটিশ সিটিজেন। সে পুলিশ ও মামলার আশ্রয় নিয়ে ডিভোর্স দিয়ে বাচ্চা নিয়ে চলে গেছে বিয়ের দুই বছরের মাথায়। সূচনা তার দ্বিতীয় বউ।

সূচনা ছিলো বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবারের সহজ-সরল, নিম্নবিত্ত পরিবারের অল্প বয়সী মেধাবী, পরমা সুন্দরী কলেজ ছাত্রী। ১৭ বছর মুখ বুজে সে সব কিছু সহ্য করে কেবল একটি আশায়, হয়তো লোকটা ভালো হয়ে যাবে অথবা সে লন্ডনে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু সূচনার এই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। তার আর লন্ডন যাওয়া হয়নি। ইদানিং নাকি সেই স্যাডিস্ট আবারো তার নাম পরিচয় গোপন করে বিদেশি সিম কার্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন কলেজ পড়ুয়া কম বয়সী, নিম্নবিত্ত, সুন্দরী মেয়েদের মোবাইলে ফোন করে প্রেমের অভিনয় করে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং শুরু করেছে।

এ পৃথিবীতে সূচনার আপন বলতে কেউ নেই। ডিপ্রেশনের চিকিৎসা করাতে এসে এবারই প্রথম নিজের জীবনের মর্মান্তিক কাহিনী জানালেন একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে। স্বামীর সাথে তার আপন ভাই-বোনের কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া তারা সবাই লন্ডন থাকে।

সূচনা কয়েকবার শ্বশুর পক্ষের আত্মীয়দের বিষয়টি জানিয়েছিলো। কিন্তু তারা নিরুপায় হয়ে জানান, এসব কিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

সূচনার স্বামী বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত বৃটিশ নাগরিক। টাকা-পয়সাও আছে। এ পরিচয় দিয়েই সে ব্ল্যাক মেইলিং করে। প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর এলে সে দেশে আসে। এবারও আসবে। কিন্তু সূচনা এবার আর যাবে না তার কাছে, ডিভোর্স দিয়ে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

চিকিৎসার জন্যে সূচনা এর আগে মাঝেমধ্যে ফ্লুপেনটিক্সল ম্যালিট্রাসিন নামক ঔষধ সেবন করতেন। তবে দীর্ঘদিন এটা সেবনে অনেক সময় সুইসাইডাল থিংকিং চলে আসে। তারও এ রকম হয়েছে। উপশমও পাচ্ছেন না।

সেক্সুয়াল সেডিজম ডিসওর্ডার সাইকোথেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি এবং এন্টিডিপ্রেসেন্ট বা অনেক ক্ষেত্রে এন্টিসাইকোটিক ওষুধ দিয়ে অত্যন্ত সফলভাবে চিকিৎসা করা যায়।

কিন্তু সূচনা তার স্বামীর চিকিৎসা করাতে চান না। কীভাবে করবেন? লোকটা তো ভয়ঙ্কর জেদী। এসব করতে গেলে তাকে গলা টিপে মেরেই ফেলবে। এমনিতে তার জীবন শেষ করে ফেলেছে আঘাতে আঘাতে, অপমানে, অপদস্তে।

লোকটার ভয়ঙ্কর চেহারা চোখে ভাসলে এখনও ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে সূচনা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি, সিলেট মেডিকেল কলেজ