পদ্মা সেতু যে কারণে বাঙালীর গর্ব

পদ্মা সেতু

বরকতুল্লাহ সুজন

একটি দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ। আর তা নেয়ার দৃপ্ত শপথের আরেক নাম পদ্মাসেতু। টলমান নদীর বুকে আজ তাই ইস্পাত কঠিন দৃঢ় স্তম্ভের দীর্ঘতম সারি।

অথচ শুরুতেই হোঁচট খেতে হয় বিদেশি প্রতিবন্ধকতাসহ শত বাধাবিপত্তিতে। সেসব কিছুকে পায়ে ঠেলে বাংলাদেশের মানচিত্রের মতোই আজ দৃশ্যমান স্বপ্নের পদ্মাসেতু।

নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এই সেতু আজ বাস্তব, দৃশ্যমান। ২০০৮ সালে দেশের দীর্ঘতম এই সেতু নির্মাণ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হলেও সেসময় অনেকের কাছেই তা ছিল দিবাস্বপ্ন।

২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া পয়েন্টে প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর নানা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দৃশ্যমান তেমন অগ্রগতি হয়নি।

২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মাসেতু নির্মাণকে অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পরপরই এ কাজে গতি আনে তারা।

দেড় বছরের মধ্যেই সেতুর বিস্তারিত নকশা এবং প্রি কোয়ালিফিকেশন ডকুমেন্ট ও মূল টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রণয়ন করে যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান MAUNSEL-AECOM।

২০১১ সালে অনুমোদিত নতুন নকশা অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ঋণ সহায়তায় এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইডিবি ও এডিবি। কিন্তু ওই বছরই তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আগাম দুর্নীতির অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক।

একপর্যায়ে ঋণচুক্তি স্থগিত করে সংস্থাটি। একই পথ অনুসরণ করে অন্য দাতারাও। বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার প্রায় দেড় বছরের চেষ্টায় তাদের শর্ত মানতে গিয়ে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় সৈয়দ আবুল হোসেনকে। কারাবরণ করতে হয় সেতুসচিব মোশারেফ হোসেন ভূইয়াকে।

২০১২ সালের জুনে চূড়ান্তভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। আটকে যায় পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রকল্প। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের একরোখা, যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

যদিও বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলা খারিজ করে কানাডার আদালত। পরবর্তিতে বিশ্বব্যাংক আবারো অর্থায়নে আগ্রহ দেখালেও নেয়া হয়নি তাদের। বিকল্প অর্থায়নের চেষ্টায় প্রচারণা চালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী।

এর মধ্যেই মালয়েশিয়া পদ্মাসেতুতে অর্থায়নের আগ্রহ দেখায়। কিন্তু রাজি হওয়ার মতো কোন শর্ত না দেয়ায় ব্যাটে-বলে হয়নি তাদের কয়েক দফা আলোচনা, প্রস্তাবনা।

২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে প্রকল্পের কাজে আসে দৃশ্যমান অগ্রগতি। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর। প্রমত্তা জলরাশিকে বশে এনে পদ্মার বুকে তোলা হয় পিলার।

এভাবে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে বসে প্রথম স্প্যান। দৃশ্যমান হয় সড়কপথের প্রথম দেড়শ’ মিটার। এভাবে গতবছরের ২০ ডিসেম্বর বসানো হয় পদ্মাসেতুর সবশেষ স্প্যান।

অবসান হয় বড় বাজেটের দীর্ঘতম সেতু নিয়ে সব শঙ্কা, প্রতিবন্ধকতার। উদ্বোধনের পর এখন এই সেতু জাতীয় সক্ষমতা আর সৌর্যের প্রতীক হয়ে দণ্ডায়মান। নিজেদের ঢাকায় গড়া গর্বের স্থাপনা।

লেখক: সাংবাদিক