মাসরুফ হোসেন
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ২০০৪ সালে প্রথম একটা কোর্স নিয়েছিলাম প্রফেসর হামিদা আক্তার বেগমের কাছে- Psychology 101. প্রায় ষোল বছর ধরে নানা সময়ে এই কোর্স কাজে এসেছে। একটা কোর্স করে অতি অবশ্যই এক্সপার্ট অপিনিয়ন দেয়া যায় না, তবে খুব বেসিক কিছু জিনিস জানা যায়। যেমন: সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সাইকোলজিস্টের পার্থক্য।
মোটা দাগে মেন্টাল হেলথ প্রফেশনালদের এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। সাইকিয়াট্রিস্টরা মূলত: মেডিকেল স্কুলের ডিগ্রিধারী ডাক্তার, যাদের স্পেশালাইজেশন সাইকিয়াট্রিতে (মনোরোগবিদ্যা); তাঁরা অন্যান্য ডাক্তারের মতই মানসিক রোগের চিকিৎসা করতে ওষুধ দিতে পারেন।
এছাড়া সাইকিয়াট্রিস্টগণ মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রায় সব সেক্টরই দেখাশোনা করেন। যার মধ্যে ওষুধ ব্যবস্থাপনা, সকল প্রকার থেরাপি ব্যবস্থাপনা, কাউন্সেলিং ইত্যাদিও পড়ে।
অধিকাংশ সাইকিয়াট্রিস্ট এক বা একাধিক সাইকোলজিস্ট এবং কাউন্সেলরের সাথে যৌথভাবে কাজ করেন। উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন এমন মানসিক রোগীকে সাইকিয়াট্রিস্টরা ওয়ান টু ওয়ান মুখোমুখি কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট বা কাউন্সেলরের কাছে রেফার করে থাকেন। একজন MD Psychiatrist হতে গেলে অসংখ্য কঠিন ধাপ পার হতে হয় আমেরিকাতে।
বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলোর একটি হচ্ছে USMLE, এটাতে উচ্চ স্কোর নিয়ে পাস করার পর চার বছর ধরে Residency ট্রেনিং করতে হয়, যার প্রথম দুই বছর যায় বিভিন্ন ওষুধ সম্পর্কে জানতে। এই ডিগ্রিটা দেয় আমেরিকান বোর্ড অফ সাইকিয়াট্রি এ্যান্ড নিউরোলজি। কারণ এটি মনোরোগবিদ্যা এবং স্নায়ুবিদ্যা দুটোর সমন্বয়।
সাইকোলজিস্টরা মূলত: মনোবিদ্যা (psychology) নিয়ে পড়াশোনা করেছেন (অনার্স/মাস্টার্স/পিএইচডি)। তাঁরা মেডিকেল ডাক্তারদের মত ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন না, তবে রোগীর মনোবিশ্লেষণ, আবেগ বিশ্লেষণ, বিভিন্ন থেরাপি প্রদান, কাউন্সেলিং ইত্যাদি করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রেই সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সাইকোলজিস্টগণ একসাথে কাজ করেন।
এছাড়াও আছেন প্রফেশনাল কাউন্সেলরগণ, যারা কাউন্সেলিং করেন। আছেন সাইকিয়াট্রিক নার্সগণ, যারা মানসিক রোগীর যত্নের ক্ষেত্রে স্পেশালাইজ করেছেন। আছেন সাইকোএ্যানালিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট (সবচেয়ে পরিচিত সম্ভবত CBT বা Cognitive Behavioral Therapy), আর্ট থেরাপিস্ট, ফ্যামিলি এ্যান্ড ম্যারেজ কাউন্সেলর সহ আরো নানা রকম ভাগ।
মূল কথা হচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্য কোনো হাওয়াই জিনিস না, এটা ডিল করতে অতি অবশ্যই প্রফেশনাল ট্রেনিং প্রয়োজন, সার্টিফিকেট প্রয়োজন, অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। বিনা ট্রেনিংয়ে যেমন প্লেন চালানো যায় না, হার্ট সার্জারি করা যায় না, একইভাবে সুইসাইডাল মেন্টাল পেশেন্টকে কাউন্সেলিংও করা যায় না।
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, স্বঘোষিতভাবে কিংবা খুব অল্প সময়ের সার্টিফিকেট নিয়ে মিডিয়াতে আবির্ভূত হচ্ছেন অনেকে, যারা নিজেদের মেন্টাল হেলথ এক্সপার্ট হিসেবে দাবি করছেন। আবারও বলি, ফেসবুকের স্বঘোষিত মেন্টাল হেলথ এক্সপার্টদের বর্জন করুন। গুগল করে আর দুই চারটা বই পড়ে সাইকোএনালাইসিস করা গেলে কেউ বছরের পর বছর সময়, শ্রম, মেধা খরচ করে সাইকোলজি/সাইকিয়াট্রি/কাউন্সেলিং নিয়ে পড়াশোনা করত না।
যদি একেবারে বেসিক কাউন্সেলিং বা ইমোশনাল সাপোর্ট দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে এনাদের ভূমিকা ঠিক আছে, কিন্তু যখন এনারা গন্ডি ছাড়িয়ে বিপজ্জনকভাবে মনের মাধুরী মিশিয়ে এটা ওটা বলে ফেলেন, এটা রোগীকে মৃত্যুর মুখেও ঠেলে দিতে পারে। মন খারাপ লাগলে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও সুহৃদগণের সাথে কথা বলতে পারেন, তবে মনের রোগের চিকিৎসা করতে প্রফেশনালদের বিকল্প নাই।
আরেকটা সমস্যা হচ্ছে- মানসিক রোগ বা ডিপ্রেশনকে ব্যক্তিগত দুর্বলতা, ধর্মীয় আচরণের অভাব (নামাজ পড়লে ডিপ্রেশন হয় না), অলসতা, প্রচেষ্টার অভাব ইত্যাদি বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা। ডিপ্রেশন বা মানসিক রোগকে ট্যাবু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এটা আরেকটা উপায়, যা অত্যন্ত অনুচিত এবং অনভিপ্রেত।
মানসিক রোগ সব দেশে, সব সামাজিক শ্রেণীতে, লিঙ্গ-বয়স-জাতীয়তা-অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক কারণেও মানসিক রোগ হয়। মস্তিষ্কের নিউরো-কেমিকেলের ব্যালেন্স উল্টোপাল্টা হয়ে গেলে তা মানসিক রোগ ডেকে আনে, যেটার সাথে উপরে উল্লিখিত সামাজিক, ধর্মীয়, পারিবারিক ইত্যাদির কোন সম্পর্ক নেই।
“ধুর কিসের ডিপ্রেশন” এইটা বলা আর “ধুর কিসের ক্যান্সার” বলার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। প্রায় সব ধরনের মানসিক সমস্যাই মস্তিষ্কের কেমিকেল বা নিউরোট্রান্সমিটারের ইমব্যালেন্সের ফল, যেটা সারাতে সঠিক চিকিৎসা/থেরাপি/ওষুধ প্রয়োজন। সাইকিয়াট্রিক হেল্প নেয়া কোনো লজ্জার কিছু না।
হাত ভেঙে গেলে যদি ডাক্তারের কাছে যেতে লজ্জা না লাগে, মানসিক অসুখে ডাক্তারের কাছে যেতে কিসের লজ্জা? আমি নিজেই গিয়েছি, এখনো মাঝে মাঝে যাই দরকার পড়লে। I am NOT ashamed of the fact that I take mental support from the professionals. ব্যক্তিগতভাবে আমি সৌভাগ্যবান, আমার কঠিন সময়ে পাশে ছিলেন আমার বাবা মা। তাঁরা প্রফেশনাল হেল্পের গুরুত্ব বুঝেছিলেন, তাই রুবেল আঙ্কেলকে খবর দিয়েছিলেন।
বহু মানুষকে জানি, যারা মানসিক রোগকে রোগ বলে স্বীকার করতেই চান না, ফলে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরেন। এ লেখাটি পড়ে যদি একজনও উপকৃত হন, তাতেই আমার পরিশ্রম সার্থক বলে মনে করব। আপনি যদি মানসিকভাবে অসুস্থ বোধ করেন, ডাক্তার দেখান। যদি আপনজন বা পরিচিত কাউকে দেখেন সে ভুগছে, তাকে বোঝান যে হেল্প নেয়াতে লজ্জার কিছু নেই।
যে সমাজ আপনাকে শেখায় যে, মানসিক রোগ বলে কিছু নাই, সেই সমাজ কিন্তু আপনার কষ্ট দূর করবে না। আপনি নিজেই নিজের পাশে দাঁড়ান, সঠিক কাজটি করুন, প্রফেশনাল মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট নিন। আর কিছু না হোক, প্রথম ধাপ হিসেবে “কান পেতে রই”এর হেল্পলাইনে কল করে নিজের কথাগুলো শেয়ার করুন। তারপর অতি অবশ্যই প্রফেশনাল চিকিৎসা নিন।
ব্রো সায়েন্স আর ফেসবুক মেন্টাল এক্সপার্টদের বর্জন করুন, সামাজিক ট্যাবু ভাঙুন। মানসিক রোগ একটা দানব, এই দানবকে বীরের মত পরাজিত করে উঠে দাঁড়ান বীরদর্পে। Be your own hero!
লেখক: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েট, এএসপি, বাংলাদেশ পুলিশ