ডা. সাঈদ এনাম
হাসপাতালে আইসিইউ বেড থাকে খুবই কম। বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোরও একই অবস্থা। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড খরচ ফ্রি হলেও বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে পেশেন্টভেদে প্রতিদিনের খরচ নুন্যতম ৩০ হাজার টাকা থেকে শুরু।
অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেই কেবল আইসিইউ বেডে স্থানান্তরিত হন পেশেন্ট। চিকিৎসার সর্বশেষ ধাপ।
আইসিইউ বেড কিন্তু চাইলেই পাওয়া যায় না। আবার আইসিইউ বেড কারো জন্যে বুকিং করেও রাখা যায় না। আবার কখনো আইসিইউ বেড খালিও থাকে। আইসিইউ বেড পেশেন্ট পান বেড খালি থাকা সাপেক্ষে। এ নিয়ম সারা বিশ্বের সকল হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোতে একই।
বিষয়টি কি রকম?
ধরুন একজন পেশেন্টের শারীরিক অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তাৎক্ষণিক এ বিষয়টি স্বজনদের অবহিত করা হয়। অতঃপর সে রোগীর ব্যাপারে আইসিইউ ওয়ার্ডে কল যাবে। সম্পুর্ণ ফাইলের একটা কপি নোটেড হবে সেখানে।
আইসিইউয়ের চিকিৎসক, নার্স, ব্রাদার, বেড এসিস্ট্যান্ট সবার আলাদা ডিউটি স্টাইল। নরমাল ওয়ার্ডে যে রকম, সে রকম না। কঠোর পরিশ্রম। কেননা প্রতি সেকেন্ডের ফলোআপ মনিটরিং করতে হয়। নানান রকমের অ্যালার্মের শব্দ ভেসে আসে।
প্রতিদিন প্রতি ওয়ার্ড থেকে বেশ কিছু কল চলে যায় আইসিইউ ওয়ার্ডে। ফলে অগ্রাধিকারভিত্তিতে সংকটাপন্ন রোগীর একটা সিরিয়াল নাম্বার পড়ে যায়।
এখন সেই সব রোগী একে একে স্থানান্তর হবে। আর স্থানান্তর হবে তখন, যখন একটি আইসিইউ বেড খালি হবে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন বিষয়টি বেশ ক্রিটিকাল।
সিরিয়াল অনুযায়ীই হবে সব। সিরিয়াল ব্রেকও করা হবে না। আবার এমনও হবে না যে, রাস্তার একজন ভিখারি যিনি আইসিইউ বেডে চিকিৎসাধীন আছেন, আর একজন ভিভিআইপি রাজাধিরাজের আইসিইউ প্রয়োজন, তখন ভিখারিকে বেড থেকে নামিয়ে দিয়ে ভিভিআইপি বা রাজাধিরাজকে ঐ বেডে তোলা হবে।
অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্ত আর আপনার অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এমন প্রতীক্ষার দৃশ্য আমরা প্রতিনিয়ত দেখি। আমাদের করার কিছুই নেই। সবাই আমাদের রোগী, সংকটাপন্ন পথের ভিখারি যেমন আমাদের রোগী, তেমনি রাজাধিরাজ বা ভিভিআইপিও আমাদের রোগী। সবাই সমান, সবার পরিচয় একই- ’রোগী’।
স্বজনরা অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকেন আইসিইউ ডিপার্টমেন্টের বারান্দায়, কায়মনোবাক্যে দোয়া করেন স্বজনদের জন্যে। অপেক্ষায় থাকেন যদি একটি বেড খালি হয়।
আইসিইউ বেড খালি হয় কীভাবে জানেন? হয় রোগী সুস্থ হলে নতুবা তিনি মারা গেলে। আইসিইউ বেড প্রদানে সারা বিশ্বে একই নিয়ম।
আইসিইউতে রোগী দেখতে গেলে অবচেতন মনে করোনা তীব্রতার কথা মানসপটে ভেসে উঠে। আহা, করোনার সময় আইসিইউ বেড নিয়ে কতই না হাহাকার পড়ে গিয়েছিলো। তীব্র শ্বাসকষ্ট, যেন পানিতে ডুবে যাচ্ছেন রোগী। আর বারান্দায় অগ্রাধিকারের লম্বা সিরিয়াল।
এমনও নজির আছে, এক পরিবারের দু’জন সংকটাপন্ন। আত্মীয় পালাক্রমে আইসিইউ বেড শেয়ার করছেন। হায় আল্লাহ, কী ভয়াবহ সেই পরিস্থিতি!
ভেবেছিলাম, করোনা থেকে বেঁচে গিয়ে দেশের বিজনেস টাইকুনরা সেই ভয়াবহ পরিণতির কথা বিবেচনা করে বেশী বেশী করে আইসিইউ বেড সমেত হাসপাতাল আর ক্লিনিক তৈরিতে মনোনিবেশ করবেন।
নাহ, কথা থাকলেও এমনটা হয়নি। অথচ একটা মহামারী বিদায় নেয় আরেকটা মহামারীর পাকাপোক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে।
লেখক: ডা. সাঈদ এনাম, ডিএমসি (কে-৫২), বিসিএস (২৪); সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি; ইন্টারন্যাশনাল ফেলো, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।