অদ্ভুত রোগটির নাম ‘কুমিরের কান্না’

Dr. Sayed Enam

ডা. সাঈদ এনাম

কুমির নাকি যখন তার শিকার করা প্রাণীকে খায়, তখন সেই প্রাণীর মর্মান্তিক পরিণতি দেখে কুমিরের নিজেরই নাকি চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় টপটপ করে জল পড়তে থাকে। একে সাহিত্যের ভাষায় অনেকে কুমিরের মায়াকান্না বলেন। এমনকি ইংলিশ পোয়েট শেক্সপিয়ারও মায়াকান্না বোঝাতে নিজের বিখ্যাত ট্রাজেডি ওথেলোতে ‌’কুমিরের কান্না’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

আসলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এ রকম মায়াকান্না বলে কিছু নেই। মূলত: কুমির যখন তার শিকারকে কামড়ে ধরে তখন নাক, মুখের অভ্যন্তরের বাতাস প্রচণ্ড বেগে চাপ দেয় আশেপাশে থাকা সাইনাসগুলোতে আর সে চাপেই কুমিরের চোখের ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থিগুলো থেকে অনবরত পানি বের হতে থাকে। ফলে তার চোখ টলমল করতে থাকে। এটা কেবল তার খাবার বেলাতেই হয়।

ঠিক যেমন চোখের সামনে মজাদার খাবার আনা হলে এমনি এমনিই মানুষের জিভে জল চলে আসে । পাকস্থথলিতেও জমতে শুরু করে নানান পাচক রস। এটা এক রকম রিফ্লেক্স বা দৈব প্রক্রিয়া। সব মানুষের বেলায়ই কম-বেশ এটি হয়ে থাকে । কিন্তু খাবার সামনে আনলে বা খাবার খেতে থাকার সময় কেউ যদি অঝোর ধারায় কান্না করতে থাকে, কিংবা তার চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরতে থাকে, তবে কেমন মনে হবে বিষয়টি ? কোন মানসিক বা ভৌতিক সমস্যা? কিংবা হাস্যকর কিছু? মোটেই তা নয়।

কালুস লাতুফের কার্টুন

মানুষের ক্ষেত্রেও কুমিরের কান্নার মতো এমন হতে পারে। বিরল এ রোগের নাম ক্রোকোডাইল টিয়ার সিনড্রোম (Crocodile Tear Syndrome) বা ‘কুমিরের কান্না’ রোগ । শুনতে বেশ অদ্ভুত লাগছে? আসলেই তাই। মানুষের অনেক রোগ আছে রহস্যময় । বিশেষ করে মানসিক ও নিউরোলজিক্যাল কিছু রোগের লক্ষণ বেশ রহস্যময়। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনো সেসব রহস্য ভেদ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

মানুষের কেন কুমিরের কান্না রোগ হয়?

কুমিরের কান্না রোগটি হয় ‘বেলস পলসি’ (Bell’s Palsy) নামে একটি নিউরোলজিকাল রোগের দীর্ঘমেয়াদি পরিণতিতে । ‘বেলস পলসি’ রোগ আমরা প্রতিনিয়ত চেম্বারে বা হাসপাতালে পাই। এ রোগে রোগীর মুখের এক পাশ অবস হয়ে যায় । চোখ বন্ধ হয় না, খাবার চিবানো যায় না, হাসতে গেলে মুখ এক দিকে বেঁকে যায়, এগুলোই হয়ে থাকে ‘বেলস পলসি’ রোগে।

সাধারণত নারীদের এই রোগ বেশি হয় এবং মুখের বাম দিক বেশি আক্রান্ত হয়। রোগটি ৩/৪ সপ্তাহে এমনি এমনি সেরে যায় । সুনির্দিষ্ট কোন ওষুধ নেই এ রোগের। তবে অবশ্যই চিকিৎকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয় এবং জটিলতা এড়াতে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয় ।

কুমিরের কান্না রোগটি প্রধানত হয় এই ‘বেলস পলসি’ রোগের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাবে। যদিও তা খুব কম দেখা যায় । বেলসি পালসি রোগে ফ্যাসিয়াল নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফ্যাসিয়াল নার্ভটির অনেক কাজের মাঝে একটি কাজ হলো খাবার মুখের সামনে আসলে বা মুখের ভেতর খাবার দিলে বিভিন্ন লালা গ্রন্থিকে সংকুচিত করে তা থেকে লালা ঝরানো । যাতে ভালোভাবে খাবারটি চিবানো যায়, গেলা যায়।

‘বেলস পলসি’ রোগটি যখন সেরে যায়, তখন ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত ফ্যাসিয়াল নার্ভটির পুনর্গঠন হতে থাকে । এই রিজেনারেশন প্রক্রিয়ার সময় ভুলবশতঃ তার কিছু শাখা তৈরি হয়ে চলে যায় পার্শ্ববর্তী টিয়ার গ্ল্যান্ড, ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড বা অশ্রু গ্রন্থিতে, যা হবার কথা না। ফলে ঘটতে থাকে এই ভৌতিক ঘটনা।

খাবার যখন সামনে আসে বা খাবার যখন মুখের ভেতর দেয়া হয়, তখনই লালার পাশাপাশি চোখ থেকেও অনবরত পানি পড়তে থাকে । এতে মনে হয় রোগী খাচ্ছে আর অঝোর ধারায় কাঁদছে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ; মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন, আমেরিকান একাডেমি অব নিউরোলজি