ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন
সম্প্রতি এলিফ্যান্ট রোডে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার নানা দিক নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ হচ্ছে। বাক-বিতণ্ডার এক পর্যায়ে ক্ষোভের সাথে ডা. জেনি বলেছেন, ’আমি এসোসিয়েট প্রফেসর। জয়েন্ট সেক্রেটারির গাড়ি আটকিয়ে আইডি দেখতে পারতেন?’
পরে অনেকের আলোচনায় এই গ্রেড বা ‘সমতুল্য’ বিষয়টি এসেছে। তথ্যগত ভুল হলো, বর্তমান সিস্টেমে সহযোগী অধ্যাপক পদ চতুর্থ গ্রেডে, যুগ্ম-সচিব পদের সমতূল্য নয়। যুগ্মসচিব ও অধ্যাপক পদ গ্রেড-৩ এ।
এতে অবশ্য ডা. জেনির ক্ষোভ অযৌক্তিক হয়ে যায় না। কারণ, স্বাস্থ্য ক্যাডারে এন্ট্রি পোস্ট অ্যাসিস্টেন্ট সার্জন বা মেডিকেল অফিসার। পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার বা এএসপি। প্রশাসন ক্যাডারের এন্ট্রি পদ সহকারী কমিশনার।
মাসদার হোসেন মামলায় রায়ের আলোকে বিচার বিভাগ পৃথককরণের পর ম্যাজিস্ট্রেসি চলে গেছে বিচার বিভাগের কাছে। সরকার আইন-শৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের যুক্তিতে বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে নির্বাহী মেজিস্ট্রেসি চালু রেখেছে।
মানছি, দায়িত্বে নিয়োজিত নির্ধারিত কর্মকর্তা বা কর্মচারীর পদমর্যাদা ধর্তব্য নয়। তাত্ত্বিকভাবে একজন ট্রাফিক কনস্টেবল দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে কাগজপত্র চাইতে পারেন, অনেক দেশে এটা ঘটে। মাহাথির মোহাম্মদের গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র চেক করার একটি জেনুইন কিংবা ফেক ছবি অন্তর্জালে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু আমাদের দেশে সংসদ সদস্য কিংবা প্রশাসনের বড় কর্মকর্তার গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র চেক করার ঘটনা বিরল হলেও সিনিয়র চিকিৎসকদের বেলায় তা হরহামেশাই ঘটছে। এর কারণ চিকিৎসকরা সার্বিকভাবে বঞ্চনা ও অবমূল্যায়নের শিকার।
সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে টাকা ও ক্ষমতার কাছে সবাই নতজানু। মেধা ও সেবা নিয়ে তারা ভাবে না। মেধার কথা বাদই দিলাম। দীর্ঘ পাঁচ বছর লেখাপড়া করে, এক বছর ইন্টার্নশিপের পর সরকারি চাকুরিতে যোগ দিয়ে একজন চিকিৎসক একটি প্রারম্ভিক ইনক্রিমেন্ট পান বাড়তি। এরপর তার পদোন্নতি হয় না সহজে।
একসাথে এইচএসসি পাশ করা সহপাঠীরা নিয়মিত পদোন্নতি পেয়ে উপরের গ্রেডে চলে যাচ্ছে। কিছুদিন পর কোটি টাকার সরকারি গাড়ি হাঁকাচ্ছে। চিকিৎসক এক পর্যায়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে মন দিয়ে হতাশা ভোলার চেষ্টা করছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেতন স্কেল কিছুটা বাড়লেও ‘মান- মর্যাদার’ উচ্চতর গ্রেড অধরাই থেকে যাচ্ছে।
লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে। ছোটবেলায় পড়া শ্লোকটি চিকিৎসকের কাছে পরিহাস হিসেবে ধরা দেয়, যখন এমবিবিএস-ইন্টার্নিশিপের পর কষ্টকর দীর্ঘ (ক্ষেত্র বিশেষে ৭/৮ বছর) স্নাতকোত্তর পাশ দেয়ার পর, সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আরও কয়েক বছর কাজ করার পর আরেকটা পদোন্নতি পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক হয়ে দেখলেন তার গ্রেড ৪ নম্বর।
তার যাতায়াতের জন্য সরকারি গাড়ি নেই। ৫ম গ্রেডের উপসচিব গাড়ি কেনার জন্য সুদমুক্ত লোন ও গাড়ি চালানোর জন্য বেতনের প্রায় অর্ধেক ভাতা পাচ্ছেন। তিনি পাচ্ছেন না! সহযোগী অধ্যাপক পদে ন্যূনতম ৫ বছর চাকরি ও আরও গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশের পর তিনি ৩য় গ্রেডের অধ্যাপক পদে আবেদনের যোগ্য হবেন।
এর উপরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ, সর্বশেষ পেস্কেলে সিলেকশন ও টাইম স্কেল বাতিল হওয়ায়। মেধাক্রমে পিছিয়ে থাকা তার সহপাঠী ও জুনিয়র অন্য গ্রেডের কর্মকর্তা চাকরিতে যোগদানের পর আর কোন ডিগ্রী বা গবেষণা ছাড়াই ৩য় গ্রেডের যুগ্মসচিব, ২য় গ্রেডের অতিরিক্ত সচিব, ১ম গ্রেডের সচিব, বিশেষ গ্রেডের সিনিয়র সচিব হয়ে মাথার উপরে বসবেন।
স্বাস্থ্য ক্যাডারে গ্রেড-১ পদ সাকুল্যে ১টি। সেখানেও নিয়মিত নিয়োগ পাওয়ার পথ কার্যত: রুদ্ধ, ভারপ্রাপ্ত আর চলতি দায়িত্ব পালনেই চাকুরিকাল পার। পুলিশ বিভাগে এই পদ আছে অন্তত: হাফ ডজন।
না, ভাগ্যবান ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রতি আমার কোন ঈর্ষা বা বিদ্বেষ নেই। তারা ভিনগ্রহ বা ভিনদেশ থেকে আসেননি। আমাদেরই ভাইবোন, বন্ধু, সহপাঠি। বরং আমি তাদের নেতৃবৃন্দের প্রশংসা করি, নিজ ক্যাডারের জন্য এটি তারা আদায় করতে পেরেছেন নিজেদের যোগ্যতায়।
আমরা পারি নাই, এটা আমাদের ব্যর্থতা। অতএব, হে তরুন চিকিৎসকগণ। একজন ৪র্থ গ্রেডের চিকিৎসকের সাথে ১৫/২০ বছরের জুনিয়র কর্মকর্তার ৯ম/১০ম গ্রেডের তুলনাকে আমি গুরুত্ব দিচ্ছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন চিকিৎসক, এই পরিচয়েই আমার মর্যাদা অনুভব করতে চাই।
গ্রেড দিয়ে মর্যাদা পেতে আরও অনেক কিছু করার আছে। তার জন্য জাতীয় রাজনীতির মোহমুক্ত, দলীয়করণের সাময়িক লোভ ও লাভের ঊর্ধ্বে থাকার মতো, যোগ্য চিকিৎসক নেতৃত্ব লাগবে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, এপিডেমিওলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটাল (ক্যান্সার হাসপাতাল), ঢাকা