একজন ক্যান্সার রোগীর কষ্ট অনুভব করা, সুস্থ কারও পক্ষে কি সম্ভব?

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন

এই ভোরবেলায় ফেসবুক খুলে প্রথমেই চোখ পড়লো দুজন ক্যান্সার রোগীর লেখায়।

প্রথমজন কয়েকমাস পাশের দেশে চিকিৎসা নিয়ে দেশে এসে বাকী চিকিৎসার জন্য ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে এসেছিলেন।

সেখানেই দেখা ও কথা হলো। আমার বড় ভাইয়ের মত। বিদেশ থেকে নিয়মিত ফেসবুকে লিখতেন বিস্তারিত। আশা-নিরাশার দোলাচলের কথা। কষ্টের কথা।

সাময়িক উপশমের কথা। আমি মনযোগ দিয়ে পড়তাম। অনুভব করার চেষ্টা করতাম। পারতাম কতটা? দ্বিতীয়জনের লেখায় উত্তর পেয়ে গেলাম। না, সম্ভব নয় একজন ক্যান্সার রোগীর শ্বাসকষ্ট অনুভব করা, সুস্থ কারও পক্ষে।

ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে দখল নিয়েছে তাঁর ফুসফুসের। চোখ সরাতে পারলাম না তাঁর প্রোফাইল থেকে।

আমার বন্ধু তালিকায় না থাকলেও সংযোগ আছে। কয়েকমাস আগে একটা অনলাইন আলোচনায় একসাথে ছিলাম।

একটার পর একটা স্ট্যাটাস পড়ছি। কি সুন্দর একটা পরিবার। লেখালেখি, সাংস্কৃতিক আবহে ঘেরা।

নিজের হাতে সাজানো বাগান। মাঝে মাঝেই লিখছেন এ জগত থেকে বিদায় নেয়ার কথা। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

একটা মানুষ কত কষ্টে কত যত্নে কত মায়ায় একটা জীবন গড়ে। সংসার সাজায়। ক্যান্সারের মত একটা ঘাতকের থাবায় যখন সেই সাজানো জগত ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা তাঁকে আচ্ছন্ন করে, সেই কষ্ট কি অন্যরা অনুভব করতে পারি?

পারলে ভালো হত। সমাজটা একটু কম নষ্ট হতো।

আমরা ডাক্তাররা কি অনুভব করতে পারি? পারলে ভালো হতো।

আজকাল প্রায়ই ‘বিশ্বমানের ক্যান্সার চিকিৎসা’ বাংলাদেশে গড়াগড়ি খাওয়ার গল্প শুনি। আমি মাঝে মাঝে বলি, বিশ্বমানের দামি যন্ত্রপাতি এখন দেশে এসেছে। সর্বশেষ আবিষ্কৃত ঔষধ পাওয়া যাচ্ছে। সর্বাধুনিক স্কিলও অনেকেই অর্জন করছেন।

কর্পোরেট চাকচিক্য এসেছে। যা নেই তা হলো, এসবের পিছনে বিশ্বমানেের মানবিকতা। যা চিকিৎসার পাশাপাশি একজন রোগীকে প্রশান্তি আর আশাবাদ জাগিয়ে লড়াইয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করতে পারে।

দ্বিতীয় রোগীর লেখাতেই শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি আর্থিক ব্যয়ের কথাটাও এসেছে। নিজের চিকিৎসার পাশাপাশি পরিবারের ভবিষ্যৎ আর্থিক সংকটের কথাও ভাবতে হয় একজন মূমুর্ষ রোগীকে।

এখানে চিকিৎসা ব্যয়ের প্রায় সত্তর ভাগ রোগীর পকেট থেকেই মেটাতে হয়। আমরা এত উন্নতি করছি, কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমরা ভাবি না। স্বাস্থ্যবীমা নিয়ে ভাবি না।

লোকের জন্য বিশ্বমানের চিকিৎসা নিয়ে বড়াই করি, শেষবেলায় তাদের প্রশমণ সেবা নিয়ে ভাবি না।

৯৫% মানুষের জন্য ন্যূনতম একটা বাংলাদেশ মান নিয়ে ভাবি না।

রোগী আর তার পরিবারের কাউন্সেলিং নিয়ে ভাবার সময় নেই আমাদের। এত এত বিত্তশালী মানুষ, টাটা-বিড়লার মত লাভ-লোকসানের ভাবনার উর্ধ্বে উঠে একটা হাসপাতাল বানিয়ে দেয়ার চিত্তবান মানুষ নেই।

সকাল সকাল মনটা বিগড়ে গেল। একটা গান শুনে মনটা শান্ত করি। আর আশাবাদী হওয়ার চেষ্টা করি।
পরের প্রজন্ম নিশ্চয়ই আরেকটু মানবিক হবে। বিত্তের সাথে চিত্তের প্রসার হবে।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, এপিডেমিওলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটাল (ক্যান্সার হাসপাতাল), ঢাকা