বুজুর্গ মানসিক রোগ বাইপোলার হাইপোম্যানিক

ডা. সাঈদ এনাম, আত্মহত্যার চিন্তা,

ডা. সাঈদ এনাম

ঘোরতর মানসিক রোগী বাইপোলার ডিসওর্ডার-হাইপোম্যানিকের প্রেজেন্টেশনটা বেশ ইন্টারেস্টিং। যারা বাইপোলার ম্যানিক, তারা বেশ ভায়োলেন্ট থাকেন।

তাদেরকে বাসা-বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যারা হাইপোম্যানিক (কম তীব্র) তাদের চিকিৎসা বাসা-বাড়িতেই সম্ভব।

হাইপোম্যানিক রোগীরা হয় আত্মীয়ের সাথে নিজে আসবেন অথবা আত্মীয়-স্বজন বুঝিয়ে সুজিয়ে বা জোরাজুরি করে নিয়ে আসবেন।

রোগীর বেশভূষা ভালই থাকবে। অনেক সময় অতিরিক্ত সাজগোছও থাকতে পারে। স্মার্ট ড্রেস আপ, লুকিং থাকতে পারে ক্ষেত্র বিশেষে। গাঢ় লাল জাতীয় রংয়ের ছড়াছড়ি থাকে তাতে। প্রাথমিক কথোপকথনে অসংগতিটা আপনার কাছে (নন -সাইকিয়াট্রিস্ট) খুব একটা ধরা পড়বে না।

কিন্তু আপনি যতই তার সাথে গল্প, আলাপ চালিয়ে যাবেন, ততই তার লক্ষণগুলো সুন্দরভাবে আপনার কাছে ফুটে উঠবে।

চেম্বারে এসেই তিনি হয়তো বলতে পারেন, ‘স্যার, দেখুন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু উনারা আমাকে জোর করে অসুস্থ বা পাগল সাজিয়ে এনেছেন। আচ্ছা স্যার, আপনার কি মনে হয় আমি অসুস্থ?’

রোগীর সাথে খুব সাবধানি হয়ে কথাবার্তা চালিয়ে নিতে হয়। আগ্রহ নিয়ে তার সাথে গল্প করতে হয়। তার সব কথা শুনতে হয়। হতে হয় একজন ভালো শ্রোতা। এতে করে ধীরে ধীরে তার মনের অবস্থাটা পরিষ্কার ভেসে উঠবে।

কথাবার্তায় ছোট-খাটো প্রশংসা করলে ভালো হয়, যেমন ‘আপনি তো বেশ স্মার্ট’, ‘বেশ যৌক্তিক, জ্ঞানী’। তার সাথে তর্ক করা কখনো সমীচীন হবে না।

যদিও তিনি অনেক কিছু বলতে পারেন, যা ধর্ম, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সামাজিক আচার-আচরণের মধ্যে পড়বে না।

কিন্তু ধৈর্য সহকারে তার কথাগুলো শুনতে হবে, কুল থাকতে হবে এবং কুল রাখতে হবে। মাঝে মধ্যে বাইপোলার হাইপোম্যানিক পেশেন্টের কথাবার্তা, যুক্তি-তর্ক এতটা চমৎকার হয় যে, তা আপনাকে মোহিত এবং দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেলবে।

তাকে আপনার একজন মহামানব, পীর, আওলিয়া বা দরবেশও মনে হতে পারে। কিংবা মনে হতে পারে নিশ্চিত কোন দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক। তিনি হয়তো আইনস্টাইনের কোন থিওরি গড় গড় করে বলতে থাকবেন।

কিংবা স্যার আইজ্যাক নিউটনের তৃতীয় সূত্র নিয়ে আলাপ জমিয়ে আপনাকে প্যাঁচে ফেলে দিতে পারেন। অথবা তিনি এও বলতে পারেন, তার সাথে জ্বীন, পরী, আজরাইলের সাথে রোজ আলাপ হয়, তারাই তাকে এসব জ্ঞান বাতলে দেন। তারা তাকে গায়েবি ক্ষমতা প্রদান করে দিয়ে যান রোজ রাতে।

তিনি বলতে পারেন, ‘তার রয়েছে ঐশ্বরিক একটা শক্তি, যা দিয়ে তিনি পার্থিব সব কিছু আগাম বুঝতে পারেন’। এমনও হতে পারে, তিনি আপনাকে অবাক করে দিয়ে তার চমৎকার সুললিত কন্ঠে একটি রোমান্টিক গান বা স্বরচিত কবিতা পরিবেশন করে আপনাকে স্তম্ভিত করে দিতে পারেন!

আর কিছু লক্ষণ থাকে, যেমন- ঘুম একেবারে কমে যেতে পারে, কেনা-কাটা বেড়ে যেতে পারে, রিস্কি জব করতে পারেন, বিপদজনক সম্পর্কে জড়াতে পারেন, মারাত্মক অর্থের অপচয় শুরু করে দিতে পারেন; নিজ পরিবারে ব্যয় নির্বাহের ক্ষমতা আদৌ নেই। কিন্তু অন্যকে উজাড় করে সব দিয়ে দেউলিয়া হয়ে যান।

তার কথাবার্তা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে অগোছালো হয়ে যেতে পারে। নিজেকে মহামানব বা ক্ষমতাধর বলেও দাবি করতে পারেন।

যাহোক, আগেই বলেছি, যতদূর সম্ভব তাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। দ্রুত সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে।

একটা কথা আপনাকে মনে রাখতে হবে, তার সাথে কখনই তর্ক বা ঝগড়া শুরু করা যাবে না। তার লাইনেই তার সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে। উদ্দেশ্য হবে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আনা।

সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে শান্ত করবেন। তার যুক্তি-তর্ক, বক্তব্য সব কিছুই শুনবেন। বিবেচনা করবেন পারিপার্শ্বিক সব কিছু। পারিবারিক ইতিহাস নিবেন।

সর্বোপরি টার্গেট হবে তাকে ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা। নিশ্চিত করবেন রোগী যাতে ওষুধ সেবন করেন।

বাইপোলার মুড ডিসওর্ডার রোগটি অনেক সময় এপিসোডিক আকারে দেখা দিয়ে থাকে (বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে, অল্প ক’দিনের জন্যে)।

মুড স্ট্যাবিলাইজার মেডিসিন দিয়ে ব্রেইনের ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা একটা ভারসাম্যপূর্ণ পর্যায়ে নিয়ে আসেন সাইকিয়াট্রিস্টরা। অনেক ধরনের মুড স্ট্যাবিলাইজার আবিষ্কৃত হয়েছে।

নিয়মিত ঔষধ খেলে এই বাইপোলার রোগ নিরাময় হতে পারে। ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বেঁচে যেতে পারে একটি পরিবার। এ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে প্রতিবছর ৩০ মার্চ পালিত হয় বিশ্ব বাইপোলার ডিসঅর্ডার সচেতনতা দিবস।

লেখক: সাইকিয়াট্রিস্ট, সহকারী অধ্যাপক, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ; ইন্টারন্যাশনাল ফেলো, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন; ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েট মেম্বার, রয়েল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্ট ইংল্যান্ড।