দৈনিক ইত্তেফাক
করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেছেন, মানসিক স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র কখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। তাই মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দেন তারা।
এ বিষয় প্রচারণার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে বিশেষ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন তারা। জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভার আয়োজন করে ডিজএবলড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (ডিআরআরএ)।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতির মহাসচিব অধ্যাপক ড. শামসুদ্দীন ইলিয়াস, দৈনিক সমকালের প্রধান প্রতিবেদক লোটন একরাম এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব তানভীন সুইটি।
সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠনের উপদেষ্টা স্বপনা রেজা। বিষয়বস্তুর ওপর ইংরেজি ডেইলি সানের সিনিয়র সাবএডিটর মেহেদী হাসান ও ডিআরআরএ’র ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট কনসালট্যান্ট জিয়ানুর কবির দুটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন।
ধারণাপত্রে বলা হয়, করোনাকালীন পরিস্থিতি ও তার পরবর্তী অবস্থায় সাধারণ জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বিশেষ জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। তাই এ বিষয়ক জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। ৩৪টি যৌথ গবেষণার ফল বলছে, ২৪ থেকে ৮৭ শতাংশ করোনা রোগী কোভিড-পরবর্তী অবসাদজনিত রোগে ভুগছেন।
পক্ষান্তরে ৬ দশমিক ৫ থেকে ৬৩ শতাংশ উদ্বেগজনিত সমস্যায়, ৪ থেকে ৩১ শতাংশ হতাশায় এবং ১২ দশমিক ১ থেকে ৪৬ দশমিক ৯ শতাংশ আঘাত-পরবর্তী উদ্বেগে ভুগছেন। ২০১৮-১৯ সালে করা এক জরিপ মতে-বাংলাদেশে প্রায় ১৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১৪ শতাংশ শিশুর মানসিক সমস্যা দেখা যায়।
বাংলাদেশ সরকার মানসিক স্বাস্থ্যকে ১০টি প্রধান সমস্যার একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অথচ এই খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের দশমিক ৫ শতাংশ। যার অধিকাংশ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং পাবনা মানসিক হাসপাতালে খরচ হয়। মানসিক সমস্যায় আক্রান্তের ৯৩ দশমিক ৩ শতাংশ চিকিৎসা গ্রহণ করেন না।
দেশে ২৬০ জন মনোচিকিৎসক, ৬৫ জন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ৫০০ জন প্রশিক্ষিত মনোবিজ্ঞানী ও ৭০০ জন প্রশিক্ষিত নার্স আছে। মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব বিস্তার এত বেশি যে, এর জন্য পৃথক অধিদপ্তরের সুপারিশ করা হয়।
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কথা উল্লেখ করে তাসমিমা হোসেন বলেন, দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিকদের হাত ধরে যে সাংবাদিকতার শুরু হয়, সে সাংবাদিকতা মানুষের কথা বলে।
তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে সংবাদপত্রের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন, এখন ব্যক্তি মানুষ থেকে শুরু করে সমাজ ও প্রতিষ্ঠানে কিছু ক্ষেত্রে অসুস্থ মানসিকতা এবং উন্নয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দেখা যায়। তা বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের মধ্যে যে দীনতা আছে তা দূর করতে সুশিক্ষার প্রয়োজন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এই উন্নয়ন ধরে রাখতে মানসিক উন্নয়ন ও মানসিক বিকাশ প্রয়োজন।
অধ্যাপক ড. শামসুদ্দীন ইলিয়াস বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দশমিক ৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ, এতে বোঝা যায় দেশে মানসিক স্বাস্থ্য কতটা উপেক্ষিত। তিনি বলেন, করোনাকালে অনেক নেতিবাচক দিক থাকলেও একটি বড় ইতিবাচক দিক হলো- এ সময় আমরা বুঝতে পেরেছি মানসিক স্বাস্থ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি শিশুদের মানসিক সুস্থতার জন্য ‘প্যারেন্টাল গাইডেন্স’ বা মা-বাবার দিকনির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যতই হোক না কেন মানসিক সুস্থতা না হলে উন্নয়ন টেকসই হবে না।
তানভীন সুইটি বলেন, ‘আমরা সকলেই করোনাকালে মানসিক টানাপড়েনের মধ্যে দিন যাপন করেছি। গণমাধ্যম আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এখন গণমাধ্যমকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি প্রচারণা করে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।’
লোটন একরাম মনে করেন করোনাকালে প্রথমসারির যোদ্ধা হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে গণমাধ্যম। স্বপনা রেজা জানান, ডিআরআরএ ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন তথা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবিকায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে আসছে।
জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি নানান সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য মানসিক সুস্থতা অত্যন্ত অপরিহার্য একটি বিষয়। বর্তমান সরকার যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে তার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষত করোনাকালীন পরিস্থিতি ও তার পরবর্তী অবস্থায় সাধারণ জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বিশেষ জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক জনসচেতনতার প্রয়োজনীয়তা আছে। গণমাধ্যম এই বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।