বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের মর্মকথা

জিয়ানুর কবির

২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর ২ এপ্রিল পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার ও অ্যাসপারাগাছ লক্ষণ নিয়ে সচেতনতা তৈরি করাই এর লক্ষ্য।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সারাবিশ্বে অটিজম সচেতনতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এই দিনটি জাতিসংঘের ৭টি স্বাস্থ্য বিষয়ক দিবসের একটি। অটিজম দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘কর্মক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তি: মহামারী পরবর্তী বিশ্বজুড়ে চ্যালেঞ্জ এবং সুবিধাসমূহ।

অটিজম একটি নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধিতা। একে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারও বলে। অটিজম মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের এমন এক জটিল প্রতিবন্ধকতা, যা শিশুর জন্মের এক বছর ছয়মাস থেকে তিন বৎসরের মধ্যে প্রকাশ পায়।

এই ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাধারণত শারীরিক গঠনে কোন সমস্যা বা ত্রুটি থাকে না এবং তাদের চেহারা ও অবয়ব অন্যান্য সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের মতই হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ছবি আঁকা, গান করা, কম্পিউটার চালনা বা গাণিতিক সমাধানসহ অনেক জটিল বিষয়ে এই ধরনের ব্যক্তিরা বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করে থাকে।

বাংলাদেশের আইনে অটিজম বৈশিষ্ট্যসমূহ

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন (২০১৩) অনুযায়ী, যাদের মধ্যে নিম্নবর্ণিত দফাসমূহে উল্লিখিত লক্ষণসমূহের মধ্যে দফা (ক), (খ) ও (গ) এর উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে এবং দফা (ঘ), (ঙ), (চ), (ছ), (জ), (ঝ), (ঞ) ও (ট) তে বর্ণিত লক্ষ্যণসমূহের মধ্যে এক বা একাধিক লক্ষণ পরিলক্ষিত হবে, তারা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি বলে বিবেচিত হবেন। যেমন-

(ক) মৌখিক বা অমৌখিক যোগাযোগে সীমাবদ্ধতা;

(খ) সামাজিক ও পারস্পরিক আচার-আচরণ, ভাববিনিময় ও কল্পনাযুক্ত কাজ-কর্মের সীমাবদ্ধতা;

(গ) একই ধরনের বা সীমাবদ্ধ কিছু কাজ বা আচরণের পুনরাবৃত্তি;

(ঘ) শ্রবণ, দর্শন, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, ব্যথা, ভারসাম্য ও চলনে অন্যদের তুলনায় বেশি বা কম সংবেদনশীলতা;

(ঙ) বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা বা অন্য কোন প্রতিবন্ধিতা বা খিচুনী;

(চ) এক বা একাধিক নির্দিষ্ট বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা এবং একই ব্যক্তির মধ্যে বিকাশের অসমতা;

(ছ) চোখে চোখ না রাখা বা কম রাখা;

(জ) অতিরিক্ত চঞ্চলতা বা উত্তেজনা, অসংগতিপূর্ণ হাসি-কান্না;

(ঝ) অস্বাভাবিক শারীরিক অঙ্গভঙ্গি;

(ঞ) একই রুটিনে চলার প্রচণ্ড প্রবণতা; এবং

(ট) সরকার কর্তৃক, সময়ে সময়ে, গেজেট নোটিফিকেশনের দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোন বৈশিষ্ট্য।

অটিজমের চিকিৎসা

অটিজম কোন রোগ নয়, এটা একধরনের প্রতিবন্ধিতা। অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমস্যার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। এগুলোর মধ্যে সংক্ষেপে কয়েকটি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো।

ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা

অনেক সময় অটিজমের বৈশিষ্ঠ্য সম্পন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা যায়। যেগুলো ব্যবস্থাপনার জন্য রেজিস্টার্ড বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মেডিসিন চিকিৎসা প্রদান করতে হয়।

যখন যে সমস্যা হয়, তখন সেই রকম চিকিৎসা দরকার হয়। উদাহরণস্বরূপ- অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তি খুববেশী ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হলে সাইকিয়াট্রিক মেডিসিন প্রদান করতে হয়।

সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা

অটিজমের বৈশিষ্ঠ্য সম্পন্ন ব্যাক্তিদের আচরণজনিত সমস্যা থাকলে সেই আচরণ পরিবর্তনের জন্য বিহেবিয়ার থেরাপি ভালো কাজ করে। তবে বিহেবিয়ার থেরাপি নিয়মিত দিতে হয়।

প্যারেন্টাল ট্রেনিং

অটিজমের বৈশিষ্ঠ্য সম্পন্ন ব্যক্তির পরিবারকে বিহেবিয়ার থেরাপিতে দক্ষ করে তুলতে হয়। এর মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরাই অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ পরিবর্তনে সহায়তা করতে পারেন।

পাশাপাশি প্যারেন্টদের মানসিক চাপ, অ্যাংজাইটি ও ডিপ্রেশন ম্যানেজ করতে শিখতে হয়, যাতে করে তারা নিজেরাও ভালো থাকতে পারেন।

স্পিচ ও ল্যাংগুয়েজ থেরাপি

অটিজমের বৈশিষ্ঠ্য সম্পন্ন ব্যক্তিদের অনেক সময় কথা বলার ক্ষেত্রে বা ভাষাগত বিকাশে সমস্যা হয়, সে ক্ষেত্রে স্পিচ থেরাপি খুব ভালো কাজ করে।

অকুপেশনাল থেরাপি

অনেক অটিজমে বৈশিষ্ঠ্য সম্পন্ন ব্যক্তির সহায়ক উপকরণের দরকার হয়, সেক্ষেত্রে অকুপেশনাল থেরাপিস্টের সহায়তা প্রয়োজন হয়। এছাড়া দৈনন্দিন জীবনের কর্মক্ষেত্র বা স্কুলে পড়তে কোন সমস্যা হলে অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা সহায়তা করে থাকেন।

ফিজিওথেরাপি

অটিজমের বৈশিষ্ঠ্য সম্পন্ন ব্যক্তির শারীরিক নড়াচড়ায় সমস্যা থাকলে বা মাংশপেশীতে কোন সমস্যা থাকলে ফিজিওথেরাপির দরকার হয়।

সামাজিক পুর্নবাসন

অটিজম নিয়ে সচেতনতা তৈরির কোন বিকল্প নেই। অটিজম বাচ্চাদের নিয়মিত সরকারি সার্ভিসের সাথে লিংক করিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সোস্যাল ওয়ার্কারের ভূমিকা অপরিসীম। সোস্যাল ওয়ার্কার অনেক সময় রিহ্যাবিলিটেশন টিমের সদস্য হিসাবে নিয়মিত হোম ভিজিটের কাজ করেন।

মনে রাখা ভালো, অটিজম কোন রোগ নয়। এটা জীবনব্যাপী একধরনের প্রতিবন্ধিতা। অটিজমে বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তিরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে সাধারণ বাচ্চাদের মতো পড়ালেখা থেকে শুরু করে সব ধরনের কার্যক্রম করতে পারেন।

তাই কেউ অটিজম সনাক্ত হলে, তার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের নিউরো ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্টের আওতায়, বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পরিচালিত হচ্ছে, যেগুলো অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে বেশ ভালো ভূমিকা রাখছে।

লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, বিএসসি (অনার্স) সাইকোলজি; এমএস ও এমফিল (ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, ঢাবি)