যে রোগী বিশ্বাস করতে চান না তিনি অন্ধ

ডা. সাঈদ এনাম, আত্মহত্যার চিন্তা,

ডা. সাঈদ এনাম

“চিকিৎসকরাও অনেক সময় রোগীর কাছ থেকে শেখেন”, ঢাকা মেডিকেলে ইন্টার্নশিপের সময় মেডিসিনের এক অধ্যাপক কথাটি বলেছিলেন। সে জন্যেই মনে হয়, “চেম্বারে সামনে বসা রোগীর মুখ দিয়ে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ বইয়ের পাতা থেকে অনেক দামী”।

দু’দিন আগে চেম্বারে একজন বয়স্ক রোগী এলেন। তিনি বললেন, তার মাথা ঘোরায়, মাথা ব্যাথা হয় আর ভুলে যান মামুলি জিনিস ইত্যাদি। সমস্যাগুলো হুট করেই শুরু।

তার আরেকটি মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিলো। তিনি দুই চোখে দেখতে পান না। দৃষ্টি পুরোটাই ঝাপসা হয়ে গেছে। মানুষ দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে দ্রুত অন্ধ হয়ে গেলে সেই বিপজ্জনক সমস্যা’টি প্রথমেই তিনি চিকিৎসকের কাছে বলবেন। অথচ এ রোগী স্বেচ্ছায় বললেন না, ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ রহস্যময় ঠেকলো!

ভিশন টেস্ট করে দেখা গেলো তার দৃষ্টি এতোটাই ঝাপসা যে, এক ফুট দুরের জিনিসও দেখতে পান না। এমনকি তিনি আমাকেও দেখতে পাচ্ছেন না। অথচ তিনি সেই সমস্যার ব্যাপারে বেশ উদাসীন। বিষয়টা রহস্যপূর্ণ!

আসুন, এই রহস্যের কারণ ভেদ করার চেষ্টা করি।

‘সেনেকা’ একজন রোমান দার্শনিক, রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন সম্রাট নিরোর উপদেষ্টা।

দার্শনিক, রাজনীতিবিদ সেনেকার স্ত্রীর একজন কৃতদাস ছিলো। তার নাম ছিলো হারপেইস্ট। হারপেইস্টের এক সময় হঠাৎ করে দৃষ্টি শক্তিতে সমস্যা দেখা দেয়। সে ভালোভাবে দেখতে পায় না। ক্রমেই অন্ধ হতে থাকে।

হারপেইস্টের এই দৃষ্টি সমস্যা নিয়ে শুরু হয় আরেক সমস্যা। কারণ হারপেইস্ট কোন ক্রমেই স্বীকার করতে চায় না যে, সে দেখতে পায় না। সে বলে,
“আমার চোখ পরিষ্কার, আমার চোখে কোন সমস্যা নেই। আসল সমস্যা হলো আমার চারপাশই অন্ধকার। আমি যে কামরায় থাকি সেই কামরাটিও অত্যন্ত অন্ধকার। মহামান্য, আপনারা বরং আমার থাকার কামরাটি পালটে দিন”।

দার্শনিক ‘সেনেকা’ হারপেইস্টের এই সমস্যা নিয়ে গভীর ভাবনায় পড়লেন। যেহেতু তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক, তিনি হারপেইস্টের দৃষ্টি সমস্যা এবং সেটা অস্বীকার করা ও বৈপরীত্য আচার-আচরণের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করলেন।

সেনেকা তার বন্ধু লুসিয়াসের উদ্দেশ্যে লেখা কয়েকটি পত্রে কৃতদাস হারপেইস্টের এই অদ্ভুত আচরণের বিষয়টি উল্লেখ করলেন এবং এ নিয়ে কিছু ফিলোসফিক্যাল ধ্যান-ধার‍ণা ব্যক্ত করলেন। যেহেতু সেনেকা ছিলেন ফিলোসোফার, তাই তিনি তার মতো করে সেটার ব্যাখ্যা লিখলেন।

যাহোক, গেলো কয়েকদিন আগে চেম্বারে একজন রোগী এলেন। তিনি বললেন, তার মূল সমস্যা হলো মাথা ঘোরানো, ভুলে যাওয়া, মুড সুইং ইত্যাদি ।

তাকে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম, তিনি তার দু’চোখে মোটেই দেখতে পান না এবং তার এই দেখতে না পাওয়া ও মাথা ঘোরানো সমস্যা একই সময়ে উদ্ভত। একটা মানুষের দৃষ্টিতে কোন সমস্যা হলে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সে সবার আগে সেটাই বলবে। অথচ সামনে বসা রোগী তার এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না।

আমি বললাম, ‘চাচা আপনি চোখে পান না। অথচ সেটা বলছেন না। তিনি স্মিত হেসে বললেন, “এই সামান্য দেখি না বাবা”।

তার উপসর্গ এবং এর সাথে বৈপরীত্য আচার-আচরণটা কি সাইকিয়াট্রিক ম্যালিংগারিং, ভিজ্যুয়াল ডিসটরসন, ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন না-কি ব্রেইন স্ট্রোক, এ নিয়ে একটু চিন্তায় পড়লাম।

যাহোক রহস্য উন্মোচনের জন্যে তাকে জরুরিভাবে একটি সিটি স্ক্যান অব ব্রেইন করিয়ে আনতে বলি। তারা দ্রুত সিটি স্ক্যান করে নিয়ে আসলেন। তাতে দেখা গেলো, তার ব্রেইনের একটা অংশে (অক্সিপিটাল লোব-এ ইনফার্কস) রক্ত সঞ্চালন মারাত্মক ব্যাহত হয়েছে।

এই অক্সিপিটাল লোব অংশটি দিয়ে মানুষের ব্রেইন চোখে তৈরি প্রতিবিম্ব দেখার ও বোঝার কাজটি করে। অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও অন্ধত্বকে অস্বীকার করা, উদাসীন থাকা, এটি সত্যিই রহস্যের। এই রোগের নাম হলো এনটন-বেবিনস্কি সিনন্ড্রোম (Anton-Babinski Syndrome) বা এনটন সিনড্রোম (Anton Syndrome)।

রোগী নিজেই জানেন না যে তিনি অন্ধ। অথবা অন্ধ হওয়া সত্বেও রোগী বিশ্বাস করে নিতে চান না যে তিনি অন্ধ। এটি একটি অতি দূর্লভ ব্রেইনের রোগ।

১৮৯৫ সালে বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান সাইকিয়াট্রিস্ট এন্ড নিউরোলজিস্ট গ্যাব্রিয়েল এনটন সর্বপ্রথম এ ধরনের এক রোগী পান। পরে গবেষণা করে রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পেশ করেন৷ তার নামানুসারে এর নাম হয় ‘এনটন সিনড্রোম’।

আমাদের ব্রেইনের অক্সিপিটাল লোবে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হলে এ উপসর্গ দেখা দেয়। সারা বিশ্বের বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালে এ পর্যন্ত এনটন বেবিনস্কি সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত মাত্র ২৮টি কেইস হিস্ট্রির উল্লেখ আছে।

লেখক: ডা. সাঈদ এনাম, ডিএমসি (কে-৫২), বিসিএস (২৪); সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি; ইন্টারন্যাশনাল ফেলো, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।