মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সময়ের দাবি

সম্পাদকীয়

মানসিক স্বাস্থ্য আর মানসিক রোগ- এই দু’টি বিষয়কে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এক করে ফেলি। সবার যেমন শারীরিক স্বাস্থ্য আছে, তেমনি আছে মানসিক স্বাস্থ্যও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জনপ্রিয় একটি উক্তি হলো- ‘There is no health without mental health’

সবারই মানসিক রোগ হবে এমন নয়। তবে, জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে ব্যক্তিকে লড়াই করতে হয়; ঠিক যেমনটা শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে তিনি করে থাকেন। বর্তমানে আমরা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সেটাই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

মানসিক স্বাস্থ্য বলতে আমরা আমাদের ভাল মানসিক অবস্থা, আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বা মোকাবেলার সক্ষমতা, সামাজিক সম্পর্ক ও জীবন সম্পর্কে আমাদের বোধগম্যতাকে বুঝিয়ে থাকি।

আর মানসিক রোগ বা সমস্যা বলতে বোঝায়, ব্যক্তির মনের এমন সংকটাপন্ন অবস্থা, যা তার চিন্তা, অনুভূতি, আচরণ ও পারস্পারিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

স্বাস্থ্য এমন কোন বিষয় নয় যে, ইচ্ছেমত একে ভালো-মন্দে পরিণত করা যায়। কেউ হয়তো সারাজীবন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী থাকেন, কেউ হয়তো দুর্বলই থাকেন। কিংবা কারো কারো ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় থাকে। অনেক বড় রোগ থেকেও ব্যক্তি তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে পারেন।

কেউ হয়তো দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক সমস্যায় পড়েন। অনেকেই হয়তো মাঝামাঝি অবস্থায় থাকেন, কালেভদ্রে অসুখে পড়েন। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।

কেউ কেউ মানসিকভাবে খারাপ বোধ করতে পারেন, যা গুরুতর মানসিক সমস্যা নয়। অনেকে দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী, কিন্তু তা মানসিক রোগ নয়।

মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো সমস্যা বুঝতে পারা এবং সচেতনতার সাথে তা মোকাবেলা করা। সুন্দর মানসিক স্বাস্থ্য মানেই শতভাগ আত্মবিশ্বাসী থাকা বা পুরোপুরি সুখী থাকা এমন নয়। বরং জীবনের নানা প্রতিকূলতা স্বত্ত্বেও মানিয়ে চলার এক ধরনের সক্ষমতার আরেক নাম এটি।

তবে মনে রাখতে হবে, মানুষকে বহু প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবনকে অতিবাহিত করতে হয়। আর তা করতে গিয়ে আমাদের ভিতরে খারাপ লাগা, অতিরিক্ত মানসিক অবসাদ, কিংবা দুঃখ ভারাক্রান্ত হওয়া- এরকম সমস্যা আসতে পারে।

এ অবস্থায় দেরি না করে আশেপাশের মানসিক স্বাস্থ্য কর্মীর সহায়তা নিতে হবে। কারণ মানসিক রোগ হলেও বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিয়ে ব্যক্তি ভাল মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে।

ঠিক যেমন শারীরিক অসুস্থতায় ব্যক্তি চিকিৎসকের সহায়তা নিয়ে পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসেন। শারীরিক রোগ যেমন মাঝে মধ্যে হয়ে আবার ব্যক্তি সেরে ওঠে, মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও তেমনটাই।

মানসিক রোগ থাকা স্বত্ত্বেও যথাযথ সহায়তা নিয়ে ব্যক্তি সুস্থভাবে জীবন-যাপন করতে পারেন; ভালভাবে থাকতে পারেন; জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পান। সেই সাথে কমিউনিটিতে অবদান রাখার পাশাপাশি জীবনের একটি সুন্দর অর্থ দাঁড় করাতে সক্ষম হন।

তবে মানসম্মত মানসিক স্বাস্থ্য সেবার জন্য প্রয়োজন যথাযথ বিনিয়োগ।

মহামারী চলে গেলেও আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে মানসিক সমস্যা দেখা যায়। দীর্ঘদিন ঘরে থাকা, প্রিয়জনের বিয়োগ, আর্থিক অনটন ইত্যাদি বাস্তব প্রতিকূলতার কারণে ব্যক্তির মাঝে একাকিত্বের অনুভূতি, অস্থিরতা ও মনোদৈহিক সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। শিশুদের মাঝে দেখা যায় খিটখিটে ভাব, অতিরিক্ত জেদ, অমনোযোগিতা ইত্যাদি।

পূর্বের অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারী পরবর্তী সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করে। গত বছর এপ্রিলে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি জরিপে তার চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে দেখা গেছে, প্রায় ৫০ শতাংশ নাগরিক বলেছেন, করোনাভাইরাস দুর্যোগ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে।

বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের শরণাপন্ন হচ্ছেন আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক ভুক্তভোগী।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারী প্রাপ্তবয়স্কদের অর্ধেকেরও বেশি বিষন্নতাজনিত এবং এক-তৃতীয়াংশ উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছেন। কোভিড-১৯ মহামারীকালে কমিউনিটিতে মানসিক চাপজনিত সমস্যা অনেকাংশে বেড়ে গেছে।

মানসিক সমস্যার পরবর্তী সুনামি মোকাবেলায় এ অঙ্গনের পেশাজীবীদের যার যার অবস্থান থেকে তৈরি থাকতে তাগিদ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

অনলাইনে যে কোন ধরনের সাইকোহেলথ সার্ভিস পেতে ক্লিক করুন

আমরা যার যার অবস্থান থেকে নিজেদের সাধ্যমতো মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারি। এই খাতে নিজের দক্ষতা ও সময় কাজে লাগানোও এক ধরনের বিনিয়োগ।

সেই সাথে এই খাতে অর্থের যোগান নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। বিশেষজ্ঞরাও দ্রুত মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্ববান জানিয়েছেন।

রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি খাত থেকে বিনিয়োগ না আসলে জ্ঞাত ও অজ্ঞাত মানসিক সমস্যার ইন্টারভেনশন দেওয়া মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের জন্য কঠিন হবে।

তাই সবাইকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী বিনিয়োগে অংশ নিয়ে এই সমস্যা মোকাবেলায় অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। যাতে প্রান্তিক পর্যায়েও মানসম্মত সেবা পৌঁছানো যায়। সেই সাথে সেবার মান বজায় রাখতে মনোবিজ্ঞানভিত্তিক সোসাইটিগুলোর অচিরেই নিবন্ধন প্রদান প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় অনলাইন সাইকোথেরাপি বা টকিং থেরাপি বেশ গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। তাই মানসম্মত ও প্রান্তিক পর্যায়ে সেবাদানের জন্য আমাদের সকল পেশাজীবীকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিনিয়োগে অংশ নিতে হবে।

নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ভাল আছে কি-না তা সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। সেই সাথে ব্যক্তি তার পরিবার, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবার প্রতি খেয়াল রাখবেন। যাতে সময়মতো সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে অল্পতেই সমস্যা মোকাবেলা সম্ভব হয়।

এছাড়াও মানসিক সমস্যা চিহ্নিত করতে যে কয়টি বিষয়ে আমরা খেয়াল রাখতে পারি, তাহলো-

১. হঠাৎ করেই ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে কি-না,

২. দীর্ঘ সময় ধরে মন খারাপ থাকছে কি-না,

৩. অধিক মাত্রায় ভয়, অস্থিরতা বা দুশ্চিন্তা হচ্ছে কি-না,

৪. সামাজিকভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছি কি-না,

৫. বারবার মরে যাওয়ার চিন্তা বা ইচ্ছা জাগছে কি-না।

এর ফলে ব্যক্তির জীবন-যাপনে যদি বিরূপ প্রভাব পড়ে, তবে আর দেরি না করে নিজ দায়িত্বে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর শরণাপন্ন হোন।