মায়ের প্রসব পরবর্তী মানসিক সমস্যা ও করণীয়

শামীমা খাতুন সাইকোহেলথ নিউজ

শামীমা খাতুন

অদৃতা (ছদ্মনাম) ২৪ বছরের একজন প্রাণবন্ত হাস্যোজ্বল তরুণী। এখন তিন সপ্তাহ বয়সী পুত্র সন্তানের মা। প্রায়ই তাকে বাচ্চার জন্য রাত জাগতে হচ্ছে, দিনে কি রাতে দু’চোখের পাতা এক করার উপায় নেই। বাচ্চা প্রসবের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত অদৃতাই ছিল সবার মধ্য মণি, কিন্তু এখন চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।

সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু সন্তান, তাও আবার বংশের প্রদীপ পুত্র সন্তান বলে কথা! বাচ্চার সামান্য শারীরিক সমস্যায় মায়ের দিকে আঙ্গুল ওঠে সবার, কেমন মা তুমি! বাচ্চাকে কোলে নেবার ধরনে ভুল, ব্রেস্ট ফিডিং করানোতে ভুল, শোয়ানো, গোসলে সর্বক্ষেত্রে, প্রতি পদে পদে ভুল!

যেন এক ভুলের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে অদৃতা। মাঝে মধ্যে মনে হয়, এই ভিড়ের মধ্যে সে যেন অদৃশ্য কেউ! ইদানিং তার মেজাজ সহজেই খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। আত্মবিশ্বাসের অভাব, মনোযোগের অভাব দেখা যাচ্ছে, খাবারে রুচি নেই। মাতৃত্বকে অসহনীয় লাগছে।

মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতের সব দরজা এক এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অসহায় বোধ করছে। ইদানিং আত্মহত্যার চিন্তাও মাথায় আসছে। আসলে অদৃতা যে সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় প্রসব পরবর্তী মায়ের মানসিক সমস্যা বলে।

প্রসব পরবর্তী মানসিক সমস্যা

মায়ের প্রসব পরবর্তী মানসিক সমস্যাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়:

  • ম্যাটার্নিটি ব্লু / বেবি ব্লু / পোস্ট পার্টাম ব্লু
  • পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন / প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা
  • পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস

সমস্যার কারণঃ

বিভিন্ন কারণে এই তিন ধরনের মানসিক সমস্যা মায়ের প্রসব পরবর্তী সময়ে দেখা দিতে পারে। হরমোনের তারতম্যজনিত জানা ও অজানা কারণ, গর্ভধারণ থেকে প্রসব পরবর্তী শারীরিক পরিবর্তন, মনোসামাজিক কারণ ইত্যাদি।

মানব শরীরে দু’ধরনের প্রজনন হরমোন থাকে; এস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরে এই প্রজনন হরমোন দশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। প্রসব পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে এই হরমোনের পতন ঘটে, যা মানসিক স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে।

এর সাথে যুক্ত হয় গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের পরিবর্তিত জীবনের অনিদ্রা, ক্লান্তি, শারীরিক পরিবর্তন, মনোসামাজিক চাপ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি। সব মিলিয়ে তার মধ্যে দেখা দিতে পারে মানসিক সমস্যা। এটা যে শুধু প্রথম বাচ্চার মায়ের ক্ষেত্রেই হয় তা নয়।

উন্নয়নশীল দেশে এই সমস্যাগুলো বেশি দেখা যায়। তাছাড়া পারিবারিক কলহ, গর্ভধারণের পূর্ব থেকেই যদি মা চাপে থাকেন, তাহলে প্রসব পরবর্তী মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

পোস্ট পার্টাম ব্লু / বেবি ব্লুজ

গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ মা বেবি ব্লুজে ভোগেন। সাধারণত বাচ্চা প্রসবের কয়েক ঘন্টা পর থেকে শুরু হতে পারে এবং দুই সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। মূলতঃ পরিবারের যথোপযুক্ত মানসিক সাপোর্ট এবং সঠিক পরিচর্যা পেলে বেবি ব্লুজ থেকে সহজেই বের হওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।

বেবি ব্লুজের লক্ষণসমূহ

  • অকারণে কান্নাকাটি
  • ক্লান্তি
  • খিটখিটে মেজাজ
  • মুড সুয়িং
  • অনিদ্র (বাচ্চা ঘুমিয়ে থাকা সত্ত্বেও)
  • দুশ্চিন্তা, ইত্যাদি
  • এই লক্ষণগুলো যদি দুই সপ্তাহের বেশি থাকে, সেক্ষেত্রে দেরি না করে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন

বেবি ব্লুজে আক্রান্ত প্রতি পাঁচজন মায়ের মধ্যে একজন পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন। বাচ্চা প্রসবের দুই সপ্তাহ পর থেকে প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা শুরু হয় এবং ৪ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময় বেবি ব্লুজের লক্ষণসহ বিষণ্নতার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য মায়ের মধ্যে দেখা যায়।

মায়ের পক্ষে একা একা এই সমস্যা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। এই পর্যায়ে রোগীকে অবশ্যই একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং একজন সাইকোথেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। কেননা এই পর্যায়ে মা তীব্র মানসিক সমস্যায় ভোগেন। অনেক ক্ষেত্রে মা বাচ্চাসহ নিজের ক্ষতির চিন্তা করেন।

পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ

  • একাকীত্ব বোধ
  • অকারণে কান্না
  • দুশ্চিন্তা
  • অমনোযোগী (নিজের ও বাচ্চার পরিচর্যার ক্ষেত্রে)
  • আগ্রহের অভাব
  • আত্মবিশ্বাসের অভাব (আমাকে দিয়ে ভালো কিছু হবে না, আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার)
  • হীনমন্যতা
  • অপরাধ বোধে ভোগা (আমি মনে হয়, ভালো মা না)
  • ক্ষুধামন্দা / অতিরিক্ত খাওয়া
  • অনিদ্র / অতিরিক্ত নিদ্রা
  • সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা, বিশেষ করে বাচ্চার কাছ থেকে
  • আত্মহত্যার চিন্তা, ইত্যাদি।

পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস

প্রসব পরবর্তী প্রতি ৫০০ মায়ের মধ্যে একজনের পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস দেখা যায়। বাচ্চা প্রসবের পর থেকে তিন মাসের মধ্যে এই রোগ দেখা দেয়। উল্লেখিত কারণসহ মা যদি আগে থেকেই কখনো সাইকোসিস রোগে ভুগে থাকেন অথবা পরিবারে সাইকোসিস রোগের ইতিহাস থেকে থাকে, সেক্ষেত্রে মায়ের পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

মায়ের মধ্যে মেজাজের উত্থান-পতন, ভয়ে কুঁকড়ে থাকা, একাকী থাকা, অপরিচ্ছন্ন জীবন যাপন, শুচিবায়ু, হ্যালুসিনেশন, ডেলিউশন দেখা দেয়। মা অনেক সময় বাচ্চাকে নিজের এবং অন্য সবার জন্য ক্ষতির কারণ বলে বিশ্বাস করে। কোন যুক্তি তাকে এই বিশ্বাস থেকে দূরে সরাতে পারে না।

অনেক সময় মায়ের দ্বারা বাচ্চার প্রাণহানি ঘটে।এক্ষেত্রে মাকে অবশ্যই একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে। নিরাপত্তাজনিত কারণে বাচ্চাকে সাময়িক সময়ের জন্য নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে। আশার কথা, যথাযথ চিকিৎসা নিলে এই রোগ নিরাময় সম্ভব।

বেবি ব্লুজ এবং পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন প্রতিরোধে করণীয়

মায়ের করণীয়

  • পার্টনারের সাথে সম্পর্ক মজবুত করুন
  • নিজের জন্য সময় বরাদ্দ করুন
  • পর্যাপ্ত ঘুম (কমপক্ষে ৭-৯ ঘন্টা)
  • পুষ্টিকর সুষম খাবার গ্রহণ
  • নিজের পরিচর্যা (গোসল, ব্রাশ, প্রয়োজনে পেডিকিউর মেনিকিউর, ম্যাসাজ, হেয়ার স্টাইল চেঞ্জ ইত্যাদি করা)
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম
  • নিজের শখের কাজে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নিজেকে ব্যস্ত রাখা (ছবি আকা, বই পড়া, লেখালিখি, বাগান করা ইত্যাদি)
  • বাসার কিছু কাজে আনন্দের সাথে অংশগ্রহণ (হতে পারে পরিবারের সদস্যদের জন্য পছন্দের কিছু রান্না)
  • বাচ্চা ও নিজের প্রয়োজন সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান রাখা
  • বিশ্বস্ত বন্ধু সার্কেল গঠন করা, যেখানে অনায়াসে মনের অব্যক্ত কথাগুলো শেয়ার করা যায়
  • মাঝে মধ্যে কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে যাওয়া

অন্যদের করণীয়

  • মা যেন একাকীত্বে না ভোগেন, সেজন্য স্বামীকে সার্বিক লক্ষ্য রাখতে হবে
  • মাকে পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ করে দেওয়া
  • বাচ্চার সব দায়িত্ব (বিশেষ করে রাত জাগা) একা মায়ের ওপর ন্যাস্ত না করে ভাগাভাগি করে নেয়া
  • বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ীর সদস্য, বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠদের মায়ের প্রতি তির্যক মন্তব্য পরিহার করতে হবে।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে নতুন মাকে প্রায়শই শুনতে হয়, তুমি কেমন মা! একটা বাচ্চাই সামলাতে পারো না! আর আমরা তো দশ দশটা বাচ্চা মানুষ করেছি এক হাতে, বাচ্চা একটু অসুস্থ হলে পরিবারের সবার আঙ্গুল মায়ের দিকেই ওঠে, আবার অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত লিঙ্গের বাচ্চা না হলে মাকেই গঞ্জনার স্বীকার হতে হয়।

মনে রাখতে হবে, কোন মেয়েই মা হয়ে জন্মায় না, তাই অযৌক্তিক কথা বলা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, একজন হাসিখুশী প্রাণবন্ত মা তার সন্তানের স্বাভাবিক বিকাশের সহায়ক হিসেবে প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

লেখক: অনারারি সাইকোথেরাপিস্ট এবং কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল